বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সন্ন্যাসীদের করণীয়--স্বামী বীরেশ্বরানন্দ
*বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সন্ন্যাসীদের করণীয়*
--স্বামী বীরেশ্বরানন্দ--------------------------------
“সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, জীবনের উচ্চ মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে গেছে এবং মানুষ অনাচারে লিপ্ত। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বে। আমরা চারিদিকে দেখতে পাচ্ছি দুঃখদায়ক দৃশ্য। এই বেদনাদায়ক অবস্থায় সন্ন্যাসী হিসেবে আমাদের কী কর্তব্য? আমরা সন্ন্যাসীরা একটা সঙ্কট অবস্থার সম্মুখীন। এ-সমস্যার সমাধান করার মাত্র দুটি পথ আমাদের আছে :- যেমন এতকাল চলে আসছে সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পারি, যেন আমাদের কিছুই করণীয় নেই সেখানে। অথবা, একান্ত আপনবোধে সমাজের দুঃখকষ্টকে অনুভব করে সাধারণ মানুষের স্তরে গিয়ে, তাদের সঙ্গে একযোগে সমাজের জন্য উন্নয়নের কাজ করতে পারি। আমি মনে করি দ্বিতীয় পথটির ওপরই বেশি জোর দেওয়া উচিত। কারণ আমরা যদি সমাজ থেকে দূরে সরে থাকি এবং জনসাধারণের সঙ্গে না মিশি, তাহলে আমাদের সন্ন্যাস আশ্রম বিপন্ন হবে এবং ক্রমে তা সবদিক থেকেই শক্তিহীন হয়ে পড়বে।
আমি যতদূর জানি, প্রায় সব সন্ন্যাসীসঙ্ঘেই ত্যাগী কর্মীর অভাব। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু এটা সুস্পষ্ট যে, আদর্শ সন্ন্যাসীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কেন? কারণ, সমাজে সাধারণত ত্যাগের আদর্শ এখন নেই। আমরা সন্ন্যাসীরা স্বর্গ থেকে আসিনি, এসেছি সমাজ থেকে। নৈতিক স্বাস্থ্যবান দৃঢ় চরিত্রবলসম্পন্ন সমাজই মাত্র পারে আদর্শ সন্ন্যাসী সৃষ্টি করতে। যদি আমরা সাধারণের সঙ্গে না মিশি এবং তাদের মধ্যে কাজ না করে এড়িয়ে চলি, তাহলে তারা কেমন করে নিজেদের সংশোধন করবে এবং ঠিক পথে চলবে? যদি তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি না হয়, তাহলে আমরাও বা কেমন করে সে সমাজ থেকে তেজস্বী-ত্যাগী ছেলেদের পাব? আর যদি এইরকম দুর্বল সমাজ থেকে ছেলেরা আসে সাধু হবার জন্য, তারা হবে যেমন
— শ্রীধর স্বামী তাঁর গীতার টীকায় বলেছেন,
‘পিশুনাঃ কলহোৎসুকাঃ’
— সবসময় পরের দোষান্বেষী এবং ঝগড়াটে! সুতরাং আমাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের কর্তব্য জনসাধারণের কাছে গিয়ে তাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করা। অধিকন্তু সাধু হিসাবে সমাজের কাছে আমাদের ঋণও রয়েছে। কেননা এতদিন আমরা সমাজের কাছে সেবা পেয়েছি। তাই জনসাধারণের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করে এবং উন্নততর ভিত্তির ওপর সমাজ-পুনর্গঠনে তাদের সাহায্য করে আমাদের সেই ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত।
“...আমাদের সাধুসমাজ ‘ইতি’-বাচক কিছু করতে পারেন। যখন স্কুল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছেলেদের চরিত্রগঠনের শিক্ষা দিতে পারছে না, তখন আমাদের সন্ন্যাসীদেরই একান্ত কর্তব্য শিক্ষার কাজটিকে হাতে তুলে নেওয়া এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের যথার্থ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা। একমাত্র ধনসম্পদ মানুষকে রক্ষা করতে পারে না
— যেমন কথায় বলে ‘মানুষ শুধু ভাত-রুটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে না’। তার বেঁচে থাকার জন্য আরও কিছুর প্রয়োজন এবং ‘আরও কিছু’ হলো জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ জাগাতে আমাদের সাধুসমাজকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক মানুষকে দেখাতে হবে
— একদিকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা এবং চরিত্রগঠনমূলক বিজ্ঞান, অপরদিকে কুটিরশিল্প এবং স্বাস্থ্যবিধি।
...“সুতরাং আমাদের সাধুরা বিশ্বের মানুষের কাছে গিয়ে, মানুষে মানুষে যে অস্বাভাবিক ভেদ এবং জাতিভেদ, কুসংস্কারজনিত অসাম্য, তা দূর করে নতুন সমাজব্যবস্থা গঠন করতে পারেন। তাঁদের উচিত আরও বেশি স্কুলকলেজ খোলা, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা শিখবে লৌকিক বিষয়ের সঙ্গে ভারতীয় জীবনের মূল্যবোধ।...”('স্বামী বীরেশ্বরানন্দ - এক দিব্য জীবন' গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)
No comments