মঠের যথার্থ ত্যাগী সন্ন্যাসীগণই ধর্মভাবরক্ষা ও প্রচারের মহাকেন্দ্র স্বরুপ হবে।
তিনি তাঁর ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে বিচরন করছেন। তাঁদের সেবা-বন্দনা করলে কালে তিনি revealed (প্রকাশিত) হবেন।”
মাননীয় বিশিষ্ট সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তকে তাঁর বক্তব্যের উত্তর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওনারই এক গুরুভাই এর কলমে ( কিছুটা সম্পাদন করা)
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে দু চার কথা না লিখলেই নয় ।
আমি ব্যাক্তিগত জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত শিষ্য ।
মিশনের কোনো সন্যাসীকে দেখে আমি দীক্ষাগ্রহণ করিনি ।
সারদা মা-র প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধা এবং ভক্তির কারণেই মিশনে আমার দীক্ষাগ্রহণ । আমার দীক্ষাগুরু প্রয়াত স্বামী আত্মস্থানন্দজি মহারাজ ।
তাঁর প্রতিও আমার শ্রদ্ধা অসীম ।
উত্তর: কোনো সন্ন্যাসীকে দেখে দীক্ষাগ্রহন করিনি অথচ দীক্ষা সেই সঙ্ঘের সন্ন্যাসীর থেকেই নিলাম।
তিনি কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় - কেন, তাহলে অন্য সন্ন্যাসীরা নয়?
আপনি বলতে চাইছেন, একটি সংঘের একজন সন্ন্যাসী পূজ্য কারণ তিনি আপনার শ্রীশ্রীগুরুদেব, আর সকলে নয় - কারণ তারা গুরুস্থানীয় নয়।
অধ্যাত্মের মধ্যেও সাংসারিক বুদ্ধির দল-বদ্ধতা।
আরে মশাই যে সঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হলেন সেই সংঘের মহান ঐতিহ্যের সমন্ধে নূন্যতম তো ওয়াকিবহাল হোন।
সংঘের ঐতিহ্য অনুসারে গুরু ও সংঘগুরু ভিন্ন নন... তাহলে কেবল একজনের প্রতিই শ্রদ্ধা কেন?
সংঘের ট্র্যাডিশন এর প্রতি যদি সত্যিই শ্রদ্ধা থাকত,
তাহলে আপনার লেখার পরের অংশে ওই সময়ে মঞ্চে আসীন পরম পূজ্য পাদ সংঘগুরু মহারাজকে তীব্র কটাক্ষে ভূষিত করতেন না।
একটা সত্যি কথা বলি,
আপনারা মঠে দীক্ষা নেন ভালোবাসায় নয়,
স্ট্যাটাস দেখাতে,
আর তাই মঠের কোনো ঐতিহ্যই মানেন না,
আসলে জানেন না।
আপনারা সংঘের সন্তান কিনা জানি না,
সংঘের বোঝা তো বটেই।
√স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত একশো বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো রকম বিচ্যুতি আমাকে কষ্ট দেয়, ক্ষুব্ধ করে ।
গত কয়েকবছর ধরে রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যকলাপে এই ক্ষোভ এই দুঃখটা বাড়ছিলই ।
গতকাল স্বামীজির চিকাগো ভাষণের স্মরণ অনুষ্ঠানে যা হল তারপর এই ক্ষোভটা প্রকাশ করা উচিত বলেই আমি মনে করি ।
রামকৃষ্ণ মিশন কখনো কোনো রাজনীতিতে জড়াবে না
--- স্বামী বিবেকানন্দের এটাই নির্দেশ ছিল ।
এই নির্দেশ মেনে রামকৃষ্ণ মিশন কখনো জড়ায়নি রাজনীতিতে ।
কিন্তু স্বামী সুহিতানন্দ স্বামী সুবীরানন্দদের রামকৃষ্ণ মিশন স্বামীজির সেই নির্দেশ থেকে ক্রমেই দূরে সরে এসেছে ।
বিচ্যুত হয়েছে ।
উত্তর: মূলের কথা - দীক্ষিত প্রতিটি রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্তই জানেন দুইটি কথা - প্রথম, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব সর্বধর্ম সমন্বয় এবং সর্বদেবদেবীস্বরূপ।
এই বিশ্বাস নিয়েই তারা দীক্ষা নেন,
জোর করে না,
নিজের শ্রদ্ধায়।
(দীক্ষার ফর্ম দৃষ্ট্যব্য)
দ্বিতীয় কথা - সঙ্ঘ শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর,
এঁকে অবমাননা করা,
শ্রীরামকৃষ্ণকে অবমাননা করা।
স্মরণ করিয়ে দিই সেই তাঁর কথা যাকে স্বামীজি মহাপুরুষ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
তাঁর কথায় loyalty to Sangha is loyalty to Thakur.
আমার সংশয় আপনি আদৌ মহাপুরুষ মহারাজের নামটাই শুনেছেন কিনা!!
কারণ আপনারা দীক্ষা নেন স্ট্যাটাস দেখাতে,
ভালোবেসে নয়।
এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে - তাবলে সঙ্ঘ যদি খারাপ কাজ করে তাহলেও মুখ বুজে থাকবো?
দেখা যাক "খারাপ" কাজটি কি, এবং তা আদৌ হয়েছে কি?
√গতকাল বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ মিশনের মঞ্চ থেকে
মুখ্যমন্ত্ৰী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছেন ।
তাকে আমি দোষ দিই না ।
তার মতো একজন মধ্যমেধার রাজনীতিকের নত্বষত্ব জ্ঞান না থাকারই কথা ।
তদুপরি তিনি বলেছেন কন্যাকুমারী নাকি রামকৃষ্ণ মিশনের থেকে দখল করে নেওয়া হয়েছে ।
এরপর বেলুড় মঠ দখল করে নেওয়া হবে ।
আমার প্রশ্ন মিশনের যে ব্ৰহ্মজ্ঞানী সন্যাসীরা কাল মঞ্চ আলো করে বসেছিলেন তারা কি করছিলেন ।
মুখ্যমন্ত্ৰী না জানতে পারেন কিন্ত এই ব্রহ্ম জ্ঞানীরা তো জানেন
একনাথ রানাডের প্রচেষ্টায়
কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলা খৃস্টান মিশনারিদের দখলদারি মুক্ত করে সেখানে গড়ে উঠেছিল বিবেকানন্দ স্মারক ।
মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যাভাষণের প্রতিবাদ করবেন না স্বামী সুবীরানন্দ, ?
যদি না করেন তাহলে কি ধরে নেব তাদেরও এই রাজনীতিতে সায় আছে ।
মুখ্যমন্ত্ৰী অভিযোগ করেছেন রামকৃষ্ণ মিশনকে নাকি ভয় দেখানো হয়েছে ।
রামকৃষ্ণ মিশন পরিষ্কার বলুক কারা তাদের ভয় দেখিয়েছে ।
যদি বলতে না পারে তাহলে তারা এটা অন্তত বলুন বেলুড় মঠ বা রামকৃষ্ণ মিশন কারো রাজনীতি করার জায়গা নয় ।
উত্তর: সাংবাদিক মহোদয় প্রশ্ন রেখেছেন, রামকৃষ্ণ মিশন রাজনীতিতে জড়িয়েছে।
কারণ - তারা নাকি কিছু "বলেননি"।
সাংবাদিক মহোদয় কে প্রশ্ন -
আপনি বা আপনি যে সংবাদপত্রের সাথে জড়িত,
সেখানে একটি সভার আয়োজন করুন,
এবং সেইখানে মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়াকে ডাকুন -
সেখানে নিজের ভাষণ দেয়ার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বলুন এমন কিছু তথ্য যেইটা আপনারা জানেন ভুল,
কিন্তু তখনি দাঁড়িয়ে তার বক্তব্যের মাঝে আপনি 'Clarification' দিন,
পারবেন কি?
তাহলে হয়তো শিষ্টাচারের শিক্ষা মিশনে যোগাযোগ করলে আপনাকে মিশন বিনামূল্যে দিয়ে দেবে।
আরেকটা পয়েন্ট,
কিছুদিন আগেও বাজারে বেশ চলতো একটি তথ্য,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাকি সঙ্ঘের পঞ্চদশ সংঘগুরু মহারাজের দীক্ষিত।
পূজ্যপাদ মহারাজ গুজরাটে থাকার সময়ে মহারাজ যে পোস্টে ছিলেন তাতে তখন তিনি দীক্ষা দানের অধিকারী ছিলেন না।
তো মঠ কি করতো?
বিবৃতি দিয়ে সেই মনগড়া তথ্য খণ্ডন করতো?
মশাই, মঠের ঢের কাজ আছে।
রামকৃষ্ণ মিশন 'সুহিতানন্দ-সুবিরানন্দের' নয়, এঁরা বহুদগ্ধ সন্ন্যাসী,
এবং জগৎটা নিশ্চিত ভাবে আপনার থেকে বেশি দেখে এই আসনে বসেছেন,
আজকে এঁরা তো কালকে অন্য কেউ।
কি বলুন তো?
সাংবাদিক অনেকেই হতে পারে,
গেরুয়া পরে একটা বিশাল সঙ্ঘের নেতৃত্ব সবাই পারেনা।
আপনি নিজেই মুখমন্ত্রী মহোদয়াকে ব্যাঙ্গ করে বলছেন -
মধ্যমেধার রাজনৈতিক।
অথচ আপনার কিন্তু ওনারই কথায় পশ্চাতে লংকাদহন হয়ে গেল।
মিশনের দিকে অঙ্গুলিনিক্ষেপ করার আগে ভাবলেন না যে মিশন যদি এটি সমর্থন করতো তাহলে মিশনের তদানীন্তন দশম সর্বাধক্ষ পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ কন্যাকুমারীস্থিত বিবেকানন্দ রকের উদ্বোধন করতেন?
√সুবীরানন্দরা এটা বলতে পারবেন না ।
কারণ তারাই রামকৃষ্ণ মিশনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার ছাড়পত্র শাসক দলকে দিয়েছে ।
দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি কয়েকবছর যাবত মিশনের বরিষ্ঠ সন্যাসীরা শাসকদলের মনোরঞ্জন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ।
উত্তর: যখন দীর্ঘ ৩০ বছর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ সিপিম-এর অত্যাচার সহ্য করেছিল,
তখন আপনি আর আপনার এই জ্বালাময়ী কালী কোথায় ছিল?
কোথায় ছিলেন আপনি যখন মন্দির ভেঙে দেয়ার ভয়ে কিছু অল্পবয়স্ক ব্রহ্মচারী গুলি-বোমা-লাঠির ভয় না করে রামকৃষ্ণের আন্তর্যাতিক মন্দির,
যা আজকে বিশ্বের মধ্যে একটি দৃষ্টব্য স্থান,
তার রক্ষনাবেক্ষন করেছে হাতে একটি লাঠি নিয়ে রাতের পর রাত?
আপনি প্রেসিডেন্ট মহারাজের উপরে আক্রমণের ভয়ের সময়ে স্বেচ্ছায় শ্রমদান করেছিলেন?
নাকি সেবাপ্রতিষ্ঠানে বোমা পড়লো যখন তখন দরজার গেট আটকেছিলেন?
ছাড়ুন মশাই,
নিজের এসি কেবিনে বসে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের উপর দুমদাম করে চারটে কথা লিখে দিতে সবাই পারে।
√শাসকদলও মিশনের সন্যাসীদের পাশে বসিয়ে ক্রমাগত রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে চলেছেন ।
গত বছর উইম্বলডনে ভগিনী নিবেদিতার স্মৃতিতে স্মারক উন্মোচন করতে গিয়ে স্বামী সুহিতানন্দ বলে এসেছিলেন এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বীকৃতি জানানো হল ।
অথচ উনি খুব ভালো মতই জানতেন ওই স্মারক প্রতিষ্ঠার পিছনে রামকৃষ্ণ মিশন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো অবদানই ছিল না ।
লন্ডন নিবাসী বাঙালিদের উদ্যোগেই ওই স্মারকটি বসেছিল ।
আমি এও জানি শুধুমাত্র শাসকদলের পছন্দের ব্যক্তি নয় বলে নিবেদিতার এক জীবনীকারকে মিশনের একটি অনুষ্ঠানে বক্তার তালিকায় রেখেও বাদ দিয়ে দেওয়া হয় ।
স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েকজন গেরুয়া ধারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নন ।
তিনি আমাদের সকলের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত ।
এই তথাকথিত সন্যাসীদের হাত থেকে রামকৃষ্ণ মিশনকে বাঁচাতেই হবে ।
তাই রামকৃষ্ণ মিশনের সমস্ত ভক্ত এবং শুভানুধ্যায়ীদের কাছে অনুরোধ,
সকলে সমস্বরে একটিই আওয়াজ তুলুন ।
রামকৃষ্ণ মিশনকে রাজনীতির আখড়া করা চলবে না ।
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ মিশনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি?
আপনার কথা শুনে আপনার বাড়ির নিচে ঘুরে বেড়ানো নেড়িকুত্তাগুলোও হাসবে।
যদি তাই হতো,
স্বামী বিবেকানন্দকে আপনি জানতেও পারতেন না।
স্বামী বিবেকানন্দকে চিনলেন কি করে মশাই?
বিবেকানন্দকে নিয়ে কটা গ্রন্থ বেরিয়েছে যেগুলি রামকৃষ্ণ মিশন প্রণীত নয়?
পরিশেষে একটা কথা,
আপনার যিনি গুরু আমার দীক্ষাও তার থেকে প্রাপ্তি হয়েছে -
তিনি দীক্ষার পরে প্রতিবার বলতেন (নিশ্চই আপনাকেও বলেছেন) যে বেলুড়মঠের সাথে যোগাযোগ ছাড়বে না,
বেলুড়মঠে বছরে একবার আসবেই, এটি গুরুস্থান,
এটি সঙ্ঘের প্রাণকেন্দ্র,
এইখানে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং স্বমহিমায় প্রকাশিত।
আরেকটি কথা,
আপনার অনেক ভাগ্য আপনার দীক্ষাদাতা গুরুদেব শরীরে নেই,
থাকলে আপনার ফোটানি বেশিক্ষন থাকতো না।
আমরা বরং সমস্বরে আওয়াজ তুলতে চাই রামকৃষ্ণ মিশন এই ধরণের ভন্ড ভক্ত মুক্ত হোক।
আর শেষ পাতে আপনার জন্যে স্বামীজির লেখা থেকেই কিছু অংশ তুলে দিলাম
সঙ্ঘ- মাহাত্ম্য
“ঠাকুর ওস্তাদ মালি ছিলেন কিনা! তাই হরেক রকম ফুল দিয়ে এই সঙ্ঘরূপ তোড়াটি বানিয়ে গেছেন।
যেখানকার যেটি ভাল,সব এতে এসে পড়েছে-কালে আরও কত আসবে।
ঠাকুর বলতেন ‘যে একদিনের জন্যেও অকপট মনে ঈশ্বরকে ডেকেছে,
তাকে এখানে আসতেই হবে।‘
যারা সব এখানে রয়েছে, তারা এক একজন মহাসিংহ,............ এরাই আবার যখন বার হবে, তখন এদের দেখে লোকের চৈতন্য হবে।
অনন্ত-ভাবময় ঠাকুরের অংশ বলে এদের জানবি।
আমি এদের ওইভাবে দেখি।
...............................................................
মঠের যথার্থ ত্যাগী সন্ন্যাসীগণই ধর্মভাবরক্ষা ও প্রচারের মহাকেন্দ্র স্বরুপ হবে।
তিনি তাঁর ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে বিচরন করছেন।
তাঁদের সেবা-বন্দনা করলে কালে তিনি revealed (প্রকাশিত) হবেন।”
-স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
খণ্ড ৯ পাতাঃ ১৫৭-১৬১
(উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০১)
No comments