প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী অভয়ানন্দ(ভরত মহারাজ) - Spirituality Religion

Header Ads

প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী অভয়ানন্দ(ভরত মহারাজ)

প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী অভয়ানন্দ

Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna

স্বামী অভয়ানন্দ (১৮৯০-১৯৮৯)

মঠ-মিশনে জয়েন করবার প্রথম থেকেই স্বামী অভয়ানন্দজীর (ভরত মহারাজের) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযােগ পেয়েছি। 
মন্দিরের সামনে পুরানাে মিশন অফিসের নিচের তলায় পূর্বদিকের ঘরে তিনি বসতেন। 
দেশবিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁর কাছে আসতেন।
 তিনি ছিলেন 
  • স্বল্পভাষী
  • বুদ্ধিমান,
  • বিচক্ষণ
  • ঝড়ঝাপটায় বিপদে-আপদে অচঞ্চল। 
তাঁকে কখনাে শাস্ত্র পড়তে বা বক্তৃতা দিতে দেখিনি
তবে মঠে বসে বহু সাধু ও ভক্তের নানা সমস্যার সমাধান করে দিতেন।।
তাঁর মুখে শুনেছি তিনি কীভাবে মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা পান ও শশী মহারাজকে উদ্বোধনে রাত জেগে সেবা করেন।
 শশী মহারাজ তখন T.B.-তে কষ্ট পাচ্ছেন।
 উদ্বোধনে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। 
সেবকরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন, যাতে তাঁর দেহের জ্বলুনি কমে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ছাপার কাগজ বাজারে সচরাচর পাওয়া যেত না। 
প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকা তখন মায়াবতীতে ছাপা হতাে
আর ভরত মহারাজ ছিলেন সেখানকার কর্মী।
 স্বামীজীর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে জেনে তিনি মায়াবতী থেকে লক্ষ্ণৌ চলে যান এবং সেখানে কাগজ জোগাড় করে গাধার পিঠে চাপিয়ে আবার হেঁটে মায়াবতী ফেরেন।
 এসব সাধুর আত্মত্যাগে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ মহীয়ান।
 আরাে শুনেছি, স্বদেশী আন্দোলনে জওহরলাল নেহরু যখন জেলে,
ভরত মহারাজ নানা বই কিনে তাঁকে পাঠাতেন।
 ঐ জেলে বসে নেহরুজী Discovery of India লেখেন।
 পরবর্তিকালে দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধি কলকাতায় এলে ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করতেন। 
একবার বেলুড় মঠেও তাঁকে দেখেছি।
 তারপর পূজাপার্বণে আমাকে ওঁদের প্রসাদ পাঠাতে বলতেন।
 তিনি যখন বেলুড় মঠের ম্যানেজার, সাধু-ভক্তদের না খাইয়ে তিনি খেতেন না।
 সন্ধ্যারতির সময়ে মন্দিরের সামনে পায়চারি করতেন যাতে ভক্তদের জুতাে না চুরি হয়।
 উৎসব-কালে তাঁর অফিসের বারান্দায় বসে আমি ভক্তদের প্রণামির টাকা নিতাম।
 ট্রেনিং সেন্টারে থাকাকালে বর্ষা ও শীতকালে আমি স্বামীজীর ঘরে ধ্যানজপ করতাম, কারণ একঘরে চার জন।
 ব্রহ্মচারী—কোনাে privacy ছিল না।
 সব ব্যাপারে মহারাজ আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। 
আমাকে নানা কাজে উৎসাহ দিতেন।

স্বামীজীর ঘরে প্রিয়নাথ সিংহের তৈরি স্বামীজীর পরিব্রাজকের ছবির oil painting ছিড়ে যায়। 
আমি বললাম, “মহারাজ, দেশ-বিদেশের লােক আসে স্বামীজীর ঘর দেখতে।
 স্বামীজীর একটা বড় ধ্যানমূর্তি বসাতে চাই।” তিনি অনুমতি দিলেন। 
আমি স্বামীজীর original meditation pose-এর ছবি নিয়ে Bombay Photo থেকে ৩০" x ৪০" সাইজের ছবি তৈরি করিয়ে তাঁর ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে বসাই।
 পরে তার ওপরের দিকে ঠাকুর ও মায়ের ছবি।
 আমেরিকা থেকে তৈরি করিয়ে এনে স্বামী প্রমেয়ানন্দজীর সময়ে বসাই।
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী অভয়ানন্দ(ভরত মহারাজ)

Sri Ramakrishna


একদিন ভরত, মহারাজ আমাকে বললেন
দেখ, দেশ-বিদেশ থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিরা মঠে আসেন।তাঁদের কেবল প্রসাদ দিই। ওঁদের হাতে ঠাকুর-স্বামীজীর কিছু বই দিতে চাই। তুমি তৈরি করাে যা টাকা লাগে আমি দেব।” 
১৯৭০ সাল। আমি Ramakrishna and His Message by Swami Vivekananda এবং Swamiji and His Message by Sister Nivedita সঙ্কলন করলাম।
East End Printers-এর মালিক প্রভাত ঘােষ তা ছাপিয়ে দেন। 
মহারাজ খুব খুশি ১৯৭১ সালে আমার আমেরিকা যাওয়ার আগে তিনি কয়েকটা practical উপদেশ দিয়েছিলেন ঃ 
ঠাকুর-স্বামীজীর ভাব প্রচার করাে। 
ভাবের ঘরে যেন চুরি না থাকে। 
মঠে যখন চিঠি দেবে copy রেখাে। 
চিঠিতে যেন কোনাে emotion না থাকে তাহলে আমরা decision নিতে পারি না। 
চিঠি লিখে পড়বে এবং দেখবে তার প্রতিটা কথা সত্য কি না, ইত্যাদি।
১৯৭১ সালের ৩১ মে বােম্বাই-এর Gateway of India-তে স্বামী হিরন্ময়ানন্দজীর ব্যবস্থাপনায় স্বামীজীর বিরাট bronze মূর্তি বসানাে হয়।
 প্রভু মহারাজ, ভরত মহারাজ, সূর্য মহারাজ প্রমুখ বহু সাধু উপস্থিত ছিলেন।
ভরত মহারাজ আমাকে খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন। 
তারপর তাঁর সঙ্গে আমার অনেক পত্রবিনিময় হয়েছে।
 সেসব চিঠির কয়েকটা অংশ। 
উদ্ধৃত করছি।
২৬//১৯৭১ : “একটা কথা—তুমি যে preacher ও লােকদের শেখাচ্ছ, এ ভাব যত না আসে তত ভাল। 
বরং মনে করতে চেষ্টা করবে, তুমিই অনেক কিছু শিখতে গিয়েছ।
 তাহলেই সত্য সত্য উদ্দেশ্য সফল হবে।”
বিজয়াদশমী, /১০/১৯৭১ ঃ “ওদেশে তুমি নতুন গিয়েছ। মনে রেখাে শিখবার তােমার বহু বাকি। 
তুমি শিক্ষার্থী। স্বামীজী বলেছেন—“My religion is to learn.' আর ঠাকুর বলেছেন, যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি।
' কথাটি মনেপ্রাণে গ্রহণ কোরাে। 
জীবনে তাতেই উপকার পাবে।”
//১৯৭৫ ঃ “ঠাকুর-মাকে সম্বল করে যখন সাধু হতে বেরিয়েছ, তখন সর্বাবস্থায় তাঁদের ওপরেই নির্ভর করে—অন্তরে তাঁদেরই চিন্তায় আনন্দে কাটাও।
 স্বামীজী অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই সঙ্ঘ গড়ে গিয়েছেন— তাঁর মূল কথাই ছিল obedience first. যারা স্বামীজীর এই নির্দেশকে অবজ্ঞা করে নিজেদের মনোেমতে পথে চলতে চায়—সে ছােটই হােক বা বড়ই হােক—তার কোনাে আধ্যাত্মিক কল্যাণ হবে না।
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য আত্মজ্ঞানলাভ।
 কর্ম সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছানাের জন্য একটা অবশ্যপালনীয় পথ। 
ঠাকুরের কাজ’–এটিই বড় কথা।
 এদেশেই কাজ কর বা ওদেশেই কাজ কর—তাতে কী এসে যায়? বেদান্তের চরমতম। 
সিদ্ধান্ত অজর-অমর-অভয় আত্মার কথা শােনাতে গিয়ে নিজেদের এত সঙ্কোচ কেন?
কোনাে personal attachment থাকা তাে আমাদের বাঞ্ছনীয় নয়। 
স্বামীজী যে-জীবন ওদেশে দেখালেন, তার অভিব্যক্তি সাধুদের জীবনে হওয়া দরকার।
 স্বামীজীর পথকেই অবলম্বন করা দরকার।
 যে কাজই হােক, যে দেশের কাজই হােক—সব ঠাকুরের—এটিই মনে রাখতে হবে।
 এত চিন্তা কীসের?
তােমাকে উদ্দেশ করেই হঠাৎ এত কথা লিখলাম কেন—এ প্রশ্ন করতে পার।
 আমার মনে হলাে, লিখলাম। 
কারণ এই সত্যকে অবলম্বন করা তােমার জন্যও যেমন প্রয়ােজন, আমার ও আমাদের সকলের জন্যও তা-ই।”

১৬//১৯৭৬ ঃ “তােমার চিঠিতে প্ৰভবানন্দ স্বামীর শরীর যাওয়ার (//১৯৭৬) বিস্তৃত বর্ণনা জেনে সব বুঝতে পারলাম। তাঁর অভাব তােমাদের কাছে কী গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, তা আমি বেশ অনুমান করতে পারছি। তবুও একথা সত্য, মুষড়ে পড়লে হবে না। 
সকল শক্তির উৎস হচ্ছেন ঠাকুর। 
তিনি সত্যস্বরূপ, পবিত্রতাস্বরূপ এবং ত্যাগীশ্বর—তাই যেখানেই সত্যনিষ্ঠা, ত্যাগ, পবিত্রতা ও সংযম সেখানেই তিনি উপস্থিত। তাঁর শক্তি সেখানেই প্রকাশিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তােমরা সবাই united হয়ে যদি একসঙ্গে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা রেখে, তাঁকে জীবনে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা কর—তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নিজেদের অহঙ্কারকে একটু দমিয়ে রাখবার জন্য সবাইকে তৎপর হতে হবে, তবেই পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালবাসা ও যথার্থ সম্প্রীতি অক্ষুন্ন থাকবে—আর সেইটিই হচ্ছে। সঘজীবনে অত্যন্ত প্রয়ােজন।... - “আমাদের failure-এর কারণ—
  • sincerity-র অভাব,
  •  ভাবের ঘরে চুরি,
  •  মন মুখ এক না করা।
 এর ফলে নিজের ব্যক্তি-জীবনের ক্ষতি তাে বটেই, সর্বোপরি সমষ্টিগতভাবে সঙ্ঘেরও ক্ষতি।
 তাই obedience দরকার— সঙ্ঘ যাতে সতেজ হয়।
 আর এর অভাবে সঙ্ঘ দুর্বল হয়ে পতে স্বামীজীও তাই এই obedience-কে এত মূল্য দিয়েছেন আমাদের সাধুজীবন গঠনের জন্য।” 
Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna


এসব প্রাচীন সাধুর আত্মত্যাগ
সঙ্ঘের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য আমাদের শিক্ষণীয়।
 ১৯৭৭ সালে আমি দেশে যাই।
ভরত মহারাজ তখন মঠের ম্যানেজার।
 আমাকে মায়ের মতাে জিজ্ঞাসা করতেন
তাের খাওয়াথাকার কোনাে অসুবিধা হচ্ছে না তাে?”
তাঁর অফিসে বসে আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতেন।
 একদিন স্বামী নিত্যস্বরূপানন্দজী (চিন্তাহরণ মহারাজ) ভরত মহারাজকে বললেন, “মহারাজ, ঠাকুর সেই ১৮৮৬ সাল থেকে সুজির পায়েস খাওয়া শুরু করেছেন এবং এখনাে তাঁকে নিত্য সুজির পায়েস দেওয়া হচ্ছে।
 তাঁর মুখে এখন খুব অরুচি। 
বেলুড় মঠে তাঁর খাওয়ার menu পালটান।” 
তখন  ভরত মহারাজ বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তােমার সঙ্গে আজকাল ঠাকুরের এই ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। বেশmenu-টা তাহলে কী হবে?”
চিন্তাহরণ মহারাজ বললেন, “কৈ-কপি, চিতলের কোলের। ঝাল, মৌরলা মাছের কাই, তপসে ভাজা ইত্যাদি।” 
তিনি যেসব পছন্দ করেন সব বলে গেলেন। 
আমি মঠের দুই বৃদ্ধ সাধু ও মায়ের শিষ্যদের কথা শুনে হাসতে লাগলাম।
ভরত মহারাজ নিবেদিতা সম্বন্ধে বলেছিলেন, “একদিন সন্ধ্যায় নিবেদিতা।
 নৌকা করে কলকাতা থেকে বেলুড় মঠে আসেন। 
তিনি সােজা পুরােনাে মন্দিরের ঠাকুরঘরে যান। 
সঙ্ঘের প্রতি তাঁর প্রাণের সংযােগ বরাবর ছিল।
 অপর একদিন নিবেদিতা স্বামী প্রজ্ঞানন্দ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মায়াবতীতে আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম।
 তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ।
 মঠ-মিশনে তাঁর মতাে original thinker—মৌলিক চিন্তাযুক্ত সাধু বিরল। তিনি ভারতের সাধনা লিখেছিলেন।
 ”
ঠাকুর বলেছেন, “ওরে গুণীর আদর করতে হয়।
ভরত মহারাজকে দেখেছি বহু জ্ঞানিগুণীর যত্ন করতেন, খাওয়াতেন, খোঁজখবর নিতেন এবং এভাবে তাঁদের মঠ-মিশনের ভক্ত করতেন।
-প্রসঙ্গে বেলুড় মঠের ম্যানেজার বাবুরাম মহারাজের একটা কাহিনি মনে পড়ে। 
উদ্বোধন অফিস থেকে ব্রহ্মচারী গণেন মন্তব্য করেন, “বাবুরাম মহারাজ মঠে হােটেল খুলে দিয়েছেন।
 কেবল ভক্তদের প্রসাদ দেন—যার জন্য মঠে এখন deficit চলছে।” লােকমুখে বাবুরাম মহারাজ তা শুনে বলেন, “গণেন ছেলেমানুষ। 
ও কী জানে? আমি মঠে ভক্তদের প্রসাদ খাওয়াই যাতে ঠাকুরের প্রতি তাদের একটু ভক্তি হয়।
 সেই ভক্তির জোরে তারা উদ্বোধনে গিয়ে ঠাকুর-স্বামীজীর বই কেনে।
 উদ্বোধনের বই বিক্রি হয় ঠাকুরের এই প্রসাদের গুণে।”
ভরত মহারাজকে দেখতাম উৎসবের সময় নকুড়ের কড়া পাকের সন্দেশ কিনে ঠাকুরকে ভােগ দিয়ে দেশ-বিদেশে পাঠাতেন।
 তিনি বেলুড় মঠে মায়ের মতাে ভক্তদের সেবা করেছেন। সাধুরা যেন অসুখ হলে একটু দুধ পায় তার দিকে লক্ষ্য রাখতেন।
 তাঁর কাছে ভক্তের সেবা আর পূজা এক ছিল।
কথায় বলে—যত হয় গুপ্ত তত হয় পােক্ত; আর যত হয় ব্যক্ত তত হয় ত্যক্ত।
 তাঁর ব্যক্তিগত জীবন খুব গুপ্ত দেখেছি।
 নিজের বিষয়ে কিছু বলতে চাইতেন না। 
তিনি জ্ঞানিগুণীদের আদরযত্ন করতেন।
 মঠ মিশনের কোনাে সমস্যা এলে তিনি ছিলেন পরামর্শদাতা।
 রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে দীর্ঘকাল সেবা করে তিনি স্মরণীয় হয়ে রইলেন।

No comments

Powered by Blogger.