দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারণীদেবী - Spirituality Religion

Header Ads

দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারণীদেবী

আজকের দিনে, ৩১ শে মে, ১৮৫৫ সালে এইদিনে স্নানযাত্রার শুভক্ষনে মহা সমারোহে রানী রাসমণি দেবী'র স্বপ্নাদেশ মতোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারণীদেবী। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধনক্ষেত্র ও এই পূণ‍্যভূমি। সেই থেকেই এই স্থানটি পূণ‍্যতীর্থ।
'কথামৃত' স্রষ্টা শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনীকার শ্রী মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত যিনি ভক্তদের কাছে মাষ্টার মহাশয় নামে খ‍্যাত, তাঁর প্রথম দর্শনের দিনটি ছিল রবিবার। জীবন নাটকের ঘুর্ণিপাকে পড়ে এই বাগান সেই বাগান ঘুরে তাঁর বোনের সঙ্গে তিনি সেদিন রাসমণি'র বাগান দেখতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কক্ষে প্রবেশ করলেন। মায়ের শ্রীরূপ দর্শন করতে সেই 'ফটোগ্রাফিক ডিটেলিং' এক কথায় অনবদ্য , মাষ্টার মহাশয় লিখেছেন---
"আজ রবিবার। ভক্তদের অবসর হইয়াছে, তাই তাঁহারা দলে দলে শ্রীশ্রীপরমহংসদেবকে দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে আসিতেছেন। সকলেরই অবারিত দ্বার। যিনি আসিতেছেন, ঠাকুর তাঁহারই সহিত কথা কহিতেছেন। সাধু, পরমহংস, হিন্দু, খ্রীষ্টান, ব্রহ্মজ্ঞানী; শাক্ত, বৈষ্ণব; পুরুষ, স্ত্রীলোক -- সকলেই আসিতেছেন। ধন্য রানী রাসমণি! তোমারই সুকৃতিবলে এই সুন্দর দেবালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, আবার এই সচল প্রতিমা -- এই মহাপুরুষকে লোকে আসিয়া দর্শন ও পূজা করিতে পাইতেছে।"
মাষ্টার মহাশয় তারপর মা ভবতারিণী দেবী'র সামনে আমাদের দাঁড় করালেন---
"দক্ষিণের মন্দিরে সুন্দর পাষাণময়ী কালী-প্রতিমা! মার নাম ভবতারিণী। শ্বেতকৃষ্ণমর্মরপ্রস্তরাবৃত মন্দিরতল ও সোপানযুক্ত উচ্চবেদী। বেদীর উপরে রৌপ্যময় সহস্রদল পদ্ম, তাহার উপর শিব, শব হইয়া দক্ষিণদিকে মস্তক -- উত্তরদিকে পা করিয়া পড়িয়া আছেন। শিবের প্রতিকৃতি শ্বেতপ্রস্তরনির্মিত।"
আমরা যেন মায়ের চিন্ময়ী রূপ দর্শন করছি---
"তাঁহার হৃদয়োপরি বারাণসী-চেলিপরিহিতা নানাভরণালঙ্কৃতা এই সুন্দর ত্রিনয়নী শ্যামাকালীর প্রস্তরময়ী মূর্তী। শ্রীপাদপদ্মে নূপুর, গুজরিপঞ্চম, পাঁজেব, চুটকি আর জবা বিল্বপত্র। পাঁজেব পশ্চিমের মেয়েরা পরে। পরমহংসদেবের ভারী সাধ, তাই মথুরবাবু পরাইয়াছেন।"এইকথাটিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীম, তারপর লিখছেন---
"মার হাতে সোনার বাউটি, তাবিজ ইত্যাদি। অগ্রহাতে -- বালা, নারিকেল-ফুল, পঁইচে, বাউটি; মধ্যহাতে -- তাড়, তাবিজ ও বাজু; তাবিজের ঝাঁপা দোদুল্যমান। গলদেশে -- চিক, মুক্তার সাতনর মালা, সোনার বত্রিশ নর, তারাহার ও সুবর্ণনির্মিত মুণ্ডমালা; মাথায় -- মুকুট; কানে -- কানবালা, কানপাশ, ফুলঝুমকো, চৌঁদানি ও মাছ। নাসিকায় -- নৎ নোলক দেওয়া। ত্রিনয়নীর বাম হস্তদ্বয়ে নৃমুণ্ড ও অসি, দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে বরাভয়। কটিদেশে নরকার-মালা, নিমফল ও কোমরপাটা।"
এত সুন্দর ভাবে এতগুলি গহনার বিব‍রণ কি করে ব‍্যাখ‍্যা করলেন তাই ভাবছি। ধন‍্য মাষ্টার মহাশয়। পরে লিখছেন মন্দিরের ভিতরকার সজ্জা----
"মন্দির মধ্যে উত্তর-পূর্ব কোণে বিচিত্র শয্যা -- মা বিশ্রাম করেন। দেওয়ালের একপার্শ্বে চামর ঝুলিতেছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ওই চামর লইয়া কতবার মাকে ব্যজন করিয়াছেন। বেদীর উপর পদ্মাসনে রূপার গেলাসে জল। তলায় সারি সারি ঘটি, তন্মধ্যে শ্যামার পান করিবার জল। পদ্মাসনের উপর পশ্চিমে অষ্টধাতুনির্মিত সিংহ, পূর্বে গোধিকা ও ত্রিশূল। বেদীর অগ্নিকোণে শিবা, দক্ষিণে কালো প্রস্তরের বৃষ ও ঈশান কোণে হংস। বেদী উঠিবার সোপানে রৌপ্যময় ক্ষুদ্র সিংহাসনোপরি নারায়ণশিলা; একপার্শ্বে পরমহংসদেবের সন্ন্যাসী হইতে প্রাপ্ত অষ্টধাতুনির্মিত রামলালা নামধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ মূর্তি ও বাণেশ্বর শিব। আরও অন্যান্য দেবতা আছেন। দেবী প্রতিমা দক্ষিণাস্য। ভবতারিণীর ঠিক সম্মুখে, অর্থাৎ বেদীর ঠিক দক্ষিণে ঘটস্থাপনা হইয়াছে। সিন্দুররঞ্জিত, পূজান্তে নানাকুসুমবিভূষিত, পুষ্পমালাশোভিত মঙ্গলঘট। দেওয়ালের একপার্শ্বে জলপূর্ণ তামার ঝারি -- মা মুখ ধুইবেন। ঊর্ধ্বে মন্দিরে চাঁদোয়া, বিগ্রহের পশ্চাদ্দিকে সুন্দর বারাণসী বস্ত্রখণ্ড লম্বমান। বেদীর চারিকোণে রৌপ্যময় স্তম্ভ। তদুপরি বহুমূল্য চন্দ্রাতপ -- উহাতে প্রতিমার শোভা বর্ধন হইয়াছে। মন্দির দোহারা। দালানটির কয়েকটি ফুকর সুদৃঢ় কপাট দ্বারা সুরক্ষিত। একটি কপাটের কাছে চৌকিদার বসিয়া আছে। মন্দিরের দ্বারে পঞ্চপাত্রে শ্রীচরণামৃত। মন্দিরশীর্ষ নবরত্ন মণ্ডিত। নিচের থাকে চারিটি চূড়া, মধ্যের থাকে চারিটি ও সর্বোপরি একটি। একটি চূড়া এখন ভাঙিয়া রহিয়াছে। এই মন্দিরে এবং ৺রাধাকান্তের ঘরে পরমহংসদেব পূজা করিয়াছিলেন।"
এতটুকু পাঠ করেই উপলব্ধি হয় আমরা এতক্ষন মা ভবতারিণী দর্শনে বিভোর হয়েছিলাম। এ এক অমর সৃষ্টি। বর্তমানে আমরা মায়ের বেদীর পাদদেশে দেখতে পাই রানীরাসমণিদেবী, শ্রীরামকৃষ্ণদেব,শ্রীসারদাদেবী, স্বামীজি এবং শ্রীগণেশদেবের বিগ্রহ।
প্রণাম মাষ্টার মহাশয় । প্রণাম রানীমা।
জয় মা ভবতারিণী জয় ঠাকুর জয় মা

No comments

Powered by Blogger.