প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী মাধবানন্দজী
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী মাধবানন্দজী
|
১৯৬৪
সালে আমি যখন বেলুড় মঠের
ব্রহ্মচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে
ছিলাম। তখন আমি স্বামী
মাধবানন্দজীর একটি সাক্ষাৎকার
নিয়েছিলাম। সেসময় '
তিনি
আধ্যাত্মিক জীবনের কিছু গােপন
রহস্য আমার কাছে ব্যক্ত
করেন।যেমন,
কীভাবে
মনের চঞ্চলতা নিয়ন্ত্রণ
করতে হয় এবং কেমন করে মনকে
অন্তর্মুখ করা যায়।
একদিন
বিছানায় মশারির মধ্যে বসে
ধ্যান করার সময় তাঁর একটি
দুর্ঘটনা ঘটে। ধ্যানের পরে
যেই নিচু হয়ে প্রণাম করতে
গিয়েছেন অমনি তিনি বিছানা
থেকে মেঝেতে পড়ে যান,
কারণ
তাঁর চতুর্দিক সম্পর্কে তিনি
তখন সজাগ ছিলেন না। তাঁর ফিমার
বােন (উরুর
হাড়)
ভেঙে
যায়। তিনি যখন হাসপাতাল থেকে
ফিরে এলেন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা
করেছিলাম,
“কেমন
আছেন মহারাজ?”
“ভালই
আছি”—তিনি উত্তর দিয়েছিলেন।
ফের আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
“আপনার
কি এখনাে ব্যথা আছে?”
তাঁর
শারীরিক
Sri
Ramakrishna
|
যন্ত্রণার
কথা মনে করিয়ে দেওয়াটা তিনি
পছন্দ করেননি। তখন তিনি আমাকে
প্রশ্ন করেছিলেন,
“তুমি
ভাল আছ তাে?”
“আজ্ঞে
হ্যাঁ,
মহারাজ”—
আমি উত্তর দিয়েছিলাম। তিনি
তৎক্ষণাৎ বললেন,
“না,
তােমার
সবকিছু ঠিক নেই। যদি কোনাে
চিকিৎসক তােমার দেহ পরীক্ষা
করেন তিনি তােমার শারীরিক
অবস্থার মধ্যে কিছু-না-কিছু
অনিয়ম দেখতে পাবেন। সম্পূর্ণ
নীরােগ শরীর হলাে একটা
পরস্পরবিরােধী কথা।” আমি এক
যথার্থ শিক্ষা পেলাম।
স্বামী
মাধবানন্দজী নবীন ব্রহ্মচারীদেরও
যেভাবে সম্মান দিতেন তা
বিস্ময়কর। মানবিক মর্যাদাকে
তিনি অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন।
এমনকী,
তাঁর
Sri
Ramakrishna
|
সেবকদেরও
কলিং বেল টিপে ডাকতে তিনি
অনিচ্ছুক ছিলেন। [তাঁর
অসুখের সময়]
তাঁর
সেবকদের ওপর দায়িত্ব ছিল ২৪
ঘণ্টাই তাঁকে দেখাশােনা করা,
আবার
তাদের নিজেদেরও কিছুটা বিশ্রামের
প্রয়ােজন হত। সেজন্য তাঁর
নৈশকালীন (রাত্রি
১১টা থেকে ভাের ৫টা অবধি)
দেখাশােনার
জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের
ব্রহ্মচারীদের তাঁর ঘরে
নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম
দিন রাত্রে ১১টা থেকে ২টা অবধি
আমি তাঁর সেবা করেছিলাম,
তারপর
অন্য আরেক জন ব্রহ্মচারীর
পালা পড়ে। এ-হেন
একজন দুর্লভ সন্তের সেবা করা
ছিল অসীম সৌভাগ্যের কথা। তাঁর
ঘরের এককোণে বসে একটি ছােট
টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে আমি
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত
পড়তাম এবং লক্ষ্য রাখতাম
যদি কলঘরে যাওয়ার সময়ে
মহারাজের কোনাে সাহায্যের
প্রয়ােজন হয়।
বিকালবেলায়
স্বামী মাধবানন্দজী তাঁর
ঘরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায়
তাঁর ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ারে
এসে বসতেন,
তাঁর
পা-দুটি
একটা বেতের মােড়ার ওপর রাখা
থাকত। একদিন তিনি যখন স্বামী
গঙ্গেশানন্দজীর সঙ্গে কথা
বলছিলেন তখন আমি সেখানে যাই।
স্বামী গঙ্গেশানন্দজী আমায়
অত্যন্ত স্নেহ করতেন,
সেজন্য
তিনি স্বামী মাধবানন্দজীর
সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে
দেন এই ভেবে যে,
হয়তাে
মহারাজ আমাকে ভাল চেনেন না।
স্বামী মাধবানন্দজী সঙ্গে
সঙ্গে বললেন,
“আমি
ওকে বিলক্ষণ চিনি। ওর মুখে
সবসময় হাসি লেগে আছে।” আমি
তাঁর এই মন্তব্যকে আমার প্রতি
তাঁর আশীর্বাদরূপে গ্রহণ
করেছিলাম।
মনে
পড়ে, স্বামী মাধবানন্দজীর
যেদিন শরীর যায় (৬
অক্টোবর,
বুধবার,
সন্ধ্যা
৬.৫০
মিঃ)
সেদিন
আমি স্বামীজীর মন্দিরের
পূর্বদিকে গঙ্গার গােল পেস্তার
ওপর বসে জপ করছিলাম। তারপর
দেখলাম,
মঠের
কর্মীরা শশানের রেলিংগুলাে
খুলছে। কৌতূহলবশে আমি উঠে
গিয়ে একজন সাধুর মুখে শুনলাম, স্বামী মাধবানন্দজী
দেহ রেখেছেন। পরদিন আমরা
সমবেতভাবে বেদপাঠ করেছিলাম।
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের একজন মহান
সাধু চলে গেলেন,
কিন্তু
রেখে গেলেন একটি আদর্শ-জীবন
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
যে-কথা
দিয়ে শুরু করেছিলাম,
স্বামী
মাধবানন্দজী সম্পর্কে কিছু
লেখা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।
তিনি ধর্মপ্রসঙ্গের আলােচক
ছিলেন না। তিনি ধর্মকে অনুশীলন
করে তার সুস্পষ্ট প্রকাশ
ঘটিয়েছিলেন। তাঁর জীবনই ছিল
তাঁর
বাণী। স্বামী মাধবানন্দজীর
পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নির্মল,
যার
অর্থ কলুষতাহীন। তিনি এই নামকে
প্রকৃতই সার্থক করেছিলেন।
তিনি ছিলেন যথার্থই একজন
মহাপ্রাণ।
No comments