প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ভূতেশানন্দজী
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ভূতেশানন্দজী
১৫/৯/১৯৭৮
তারিখে তিনি আমাকে লিখেছিলেন
ঃ “আমার অমরনাথ দর্শনের ও
হার্টের গােলযােগের সব খবর
পেয়েছ। আমার খুব আনন্দ হয়েছিল,
হার্টের
বেদনা সত্ত্বেও। প্রথম বেদনা
হয় রাত্রিতে—শেষনাগে।
দ্বিতীয়বার পরের দিন
রাত্রিতে—পঞ্চতরণীতে। তৃতীয়
দিন রাত্রিতে আবার শেষনাগে
ফিরে। সঙ্গে ডাক্তার,
ওষুধ
ও অক্সিজেন—সবই ছিল এবং এসবের
প্রয়ােগে ব্যথাও কিছুক্ষণ
পরে কমেছিল। কিন্তু শ্রীনগরে
এসে ই.সি.জি.
করে
দেখা গেল হার্ট একটু damage
হয়েছে।
আগে থেকেই আমার angina
ছিল।
High
altitude-এ
তাই বেদনা অপেক্ষাকৃত তীব্র
বােধ হয়েছিল।...
কাশ্মীরে
অমরনাথ ও ক্ষীরভবানীর সঙ্গে
স্বামীজীর স্মৃতি জড়িত বলে
এ-জায়গা
দুটির ওপরে খুব আকর্ষণ ছিল।
এখন আর ঘােরার ইচ্ছা বেশি
নেই।”
কাঁকুড়গাছিতে
মহারাজ দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি
করেছিলেন। সন্ধ্যায় প্রচুর
ভক্তসমাগম হতাে। তিনি বেড়িয়ে
এসে বাইরে বসতেন। আমিও একদিন
তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
ভক্তেরা যেন আফিং-খেকো
ময়ূরের মতাে তাঁর কাছে আসত
এবং তিনি হাসিঠাট্টার মধ্য
দিয়ে সৎপ্রসঙ্গ করতেন।
কাঁকুড়গাছিতে তাঁর সাপ্তাহিক
ক্লাসগুলি খুব মর্মস্পর্শী
হতাে। ধন্য ভক্তেরা!
তাঁদের
মধ্যে কেউ কেউ মহারাজের সব
বক্তৃতা ও ক্লাস টেপ করে রাখাতে
কতকগুলি অমূল্য গ্রন্থ তৈরি
হলাে—শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতপ্রসঙ্গ,
কঠ
উপনিষদ,
মুণ্ডক
উপনিষদ,
শ্রীমদ্ভাগবত।
পরবর্তিকালে
তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হয়ে
বেলুড় মঠে যান,
আমি
মজা করে বলেছিলাম,
“আপনি
কলম না ধরে লেখক হলেন। আপনি
কথামৃত মাত্র তিন খণ্ড শেষ
করেছেন। বাকি দুই খণ্ড!”
তিনি
বললেন,
“কাঁকুড়গাছিতে
থাকলে শেষ হতাে। এখন আর সম্ভব
নয়।” আমি বললাম,
“আপনাকে
প্রেসিডেন্ট করে আমাদের
লােকসান হলাে। তা না হলে আরাে
কত গ্রন্থ তৈরি হতাে।” মহারাজ
হাসতে লাগলেন। শাস্ত্রের
পরিপ্রেক্ষিতে ঠাকুরের কথার
ঐরূপ প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কোনাে সাধু
করেননি। আমি মহারাজের বক্তৃতা
ধরে রাখবার জন্য আমেরিকা থেকে
লােক মারফত ক্যাসেট টেপ পাঠাতাম।
Sri
Ramakrishna
|
১৯৮২
সালে আমি দ্বিতীয়বার ভারতে
যাই। ৩০/৭/৮২
তারিখে মহারাজকে দেখতে
কাঁকুড়গাছিতে গিয়েছিলাম।
মহারাজকে দীক্ষা সম্বন্ধে
কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলাম।
তিনি সংক্ষেপে বললেন,
“মন্ত্র-রহস্য
হচ্ছে। ‘তজ্জপস্তদর্থভাবনম্'—অর্থাৎ
জপের অর্থ বা ইষ্টের ভাবনা
করতে হবে। মন্ত্রজপের সঙ্গে
ধ্যান করতে হয়।” আমি বললাম,
“কীভাবে?”
মহারাজ
উত্তর দিলেন,
“গুণসহ।
তিনি করুণাময়,
কৃপাসিন্ধু,
পবিত্রতা
ও ত্যাগের মূর্তি। গােপীরা
কৃষ্ণকে বিভিন্নভাবে ধ্যান
করত। যার কাছে যেটা appeal
করে।
আপনবােধ আনাটাই আসল ব্যাপার।
মা সন্তানকে ভালবাসে,
এর
মধ্যে কোনাে দর্শন বা যুক্তি
নেই। কেন ভালবাসি—জানি না।
“ ইষ্ট’
শব্দ ই ধাতু থেকে এসেছে। ইনি
আমার ঈপ্সিত,
বাঞ্ছিত।
আমি এঁকে পেতে ইচ্ছা করি।
আদর্শ হলাে—আমি ঐ হতে ইচ্ছা
করি।
“মন্ত্র—ওঁ
হচ্ছে ব্রহ্মের প্রতীক,
বীজ
শক্তির প্রতীক,
ইষ্ট
অবতারের বা কোনাে দেবতার
প্রতীক। ব্ৰহ্ম,
শক্তি
ও অবতার এক।
“করজপ
প্রশস্ত। উপাংশু জপে ঠেটি
একটু নড়ে,
কিন্তু
মানসজপে ঠোঁট নড়বে না।
নিঃশ্বাসের সঙ্গে জপ সবার
পক্ষে প্রযােজ্য নয়। পুরশ্চরণ’
হলাে। নিত্য
নির্দিষ্ট সংখ্যক জপের
সিদ্ধান্ত।
“জপের
ফল—যা বাসনা তা-ই
মিলবে ভগবকৃপায়। অভ্যুদয়
চাইলে তা-ই
মিলবে। ভগবান চাইলে তা-ই
মিলবে। তিনি দয়াময়,
ভক্তের
মনােবাঞ্ছা পূরণ করেন,
যেমন
মা সন্তানের আবদার পূরণ করেন।”
১৬/৩/১৯৯৮
তারিখে আমি মহারাজকে লিখি ঃ
“সাধনভজন সম্বন্ধে। আমাদের
দুটি প্রামাণ্য বই আছে—ধর্মপ্রসঙ্গে
স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও পরমার্থ
প্রসঙ্গ। জপধ্যান সম্বন্ধে
আমাদের মনে নানাবিধ প্রশ্ন
ওঠে। দীক্ষাকালে অনেকে একসঙ্গে
দীক্ষা নেয় এবং অনেকে সঙ্কোচে
প্রশ্ন করে না। তাছাড়া অনেকের
দীক্ষা,
গুরু,
মন্ত্র
সম্বন্ধে ভাল ধারণাও নেই।
তাই এই প্রশ্নগুলি,
যা
তাড়াতাড়ি মনে পড়ল—লিখলাম।
আপনি যদি দয়া করে সময় ও
সুবিধামতাে টেপে বিশদভাবে
(সংক্ষেপে
নয়)
বলেন,
তবে
খুবই ভাল হয়। এটি একটি মূল্যবান
দলিল হয়ে থাকবে এবং পুস্তিকাকারে
ছাপা যেতে পারে। আপনি তাে আর
নিজ হাতে লিখবেন না। এটি আমার
ও অনেকের আবদার।” আমি ৪২টা
প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। ২২/৪/১৯৯৮
তারিখে স্বামী নিত্যমুক্তানন্দ
পত্রোত্তরে লিখল ঃ “আপনার
প্রশ্নগুলির উত্তর এখনাে
শুরু হয়নি সময় লাগবে মনে
হয়। তারপর তাে আগস্টে মহারাজ
চলে গেলেন।
Sri
Ramakrishna
|
১৯৮২
সালে আমি জাপানে যাই তখন
সেখানকার Nippon
Vedanta Kyokai বেলুড়
মঠের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
জাপানে মহারাজের বহু দীক্ষিত
ভক্ত আছেন। তাঁদের মহারাজের
প্রতি ভক্তিবিশ্বাসের প্রকাশ
দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।
১৪/১২/৮২
তারিখে মহারাজ আমাকে জলপাইগুড়ি
থেকে। লিখেছিলেন ঃ “জাপানি
ভক্তেরা চিঠিতে জানিয়েছে
যে,
তারা
তােমাকে পেয়ে খুব আনন্দ
পেয়েছে। জেনে খুব খুশি হলাম।
স্থায়ী কোনাে সাধুকে এখনাে
পর্যন্ত দেওয়া গেল না। এজন্য
তারা খুব দুঃখিত।” ১৯৮৪ সালে
ঐ
কেন্দ্র
বেলুড় মঠের অন্তর্ভুক্ত
হয়। ২/২/১৯৮৬
তারিখে মহারাজ লিখলেন :
“তুমি
জুলাই মাসে আসছ জেনে আনন্দিত
হলাম।..
আজকাল
আমার ঘােরাঘুরি খুব বেড়ে
গিয়েছে। তবে আশা করি জুলাই
মাসে তুমি এলে আমার সঙ্গে দেখা
না করে ফিরে যাবে না। তােমার
definite
programme পেলে
সেই অনুসারে adjust
করতে
চেষ্টা করব।” আমার মতাে একজন
নগণ্য ব্যক্তির প্রতি তাঁর
অপরিসীম স্নেহের কথা চিন্তা
করলে মনে এক অপার্থিব আনন্দ
বােধ করি। জন্মাষ্টমীর আগের
দিন (২৬/৮/৮৬)
কাঁকুড়গাছিতে
গেলে মহারাজ ছদ্মগাম্ভীর্যে
বললেন,
“দেখ,
এখানে
তিন রাত্রি থাকতে হবে। জেনে
রাখাে,
পুলিশ
কমিশনার [বিকাশকলি
বসু]
আমার
ভক্ত। যদি না থাক,
তােমাকে
house
arrest করে
রাখা হবে।” সেদিন কাঁকুড়গাছিতে
জনসমুদ্র দেখলাম। মহারাজ এক
সামিয়ানার নিচে বসে ভক্তদের
প্রণাম নিচ্ছেন। গরমে তাঁর
খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার ভয়
হলাে যে,
তিনি
অসুস্থ হয়ে পড়বেন। শিখরেশ
এক ফাঁকে মহারাজকে একটু ডাবের
জল খাইয়ে দিল। তিনি শরীর ভুলে
হাসিমুখে ভক্তদের দর্শন দিতে
লাগলেন। ১৯৮৮ সালে সেন্ট লুইস
বেদান্ত সােসাইটির সুবর্ণজয়ন্তী
উপলক্ষ্যে আমরা মহারাজকে
নিমন্ত্রণ করলাম এবং তাঁর
টিকিটের টাকা পাঠালাম। মহারাজ
স্বামী নিত্যমুক্তানন্দকে
সঙ্গে নিয়ে টোকিও থেকে ১৮
আগস্ট লস এঞ্জেলেস পৌঁছান।
স্বাহানন্দজী,
আমি
ও অনেক ভক্ত এয়ারপাের্টে
মহারাজকে স্বাগত জানাতে
উপস্থিত ছিলাম। সেখানেই
ক্লান্ত মহারাজকে স্বাহানন্দজী
বললেন,
“আজ
সন্ধ্যায় আপনি কিছু বলবেন?”
তিনি
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন।
Sri
Ramakrishna
|
এই দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর তাঁর বিশ্রামের বিশেষ প্রয়োজন ছিল কিন্তু মহারাজ তা ভুক্ষেপ না করে সঙ্গে সঙ্গে বলতে রাজি হলেন। ২২/৮/১৯৮৮ তারিখে মহারাজ ডিজনিল্যান্ড দেখতে যান। তারপর সেখান থেকে বিকালে টুবুকো ফেরেন। ডিজনিল্যান্ডের পার্কিং-এ দারুণ বিভ্রাট হয়। কৃষ্ণানন্দ কোথায় গাড়ি পার্ক করেছিল ভুলে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টা লাগল ঐ গাড়ি খুঁজে পেতে। আমি ৪টা নাগাদ উঁবুকোতে পৌঁছে দেখি মহারাজের খাওয়া হয়নি। কোনােমতে কিছু মুখে দিয়ে তিনি লাইব্রেরি হলে বক্তৃতা দিতে গেলেন। স্বাহানন্দজী অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমি মহারাজকে শ্রোতাদের সঙ্গে পরিচয় করালাম। আমি শ্রীশ্রীমায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে বললাম, “Ivory খুব মূল্যবান এবং তা ivory যদি gold দিয়ে মােড়া থাকে তবে তা আরাে মূল্যবান হয়। যে ইনি একজন উচ্চস্তরের সাধু, তার ওপর খুব পণ্ডিত ব্যক্তি...।” ব্যস! মহাত ভালভাবে আমার কথা শুনতে পাননি। Gold-এর পরিবর্তে coal শুনেছেন। বক্তৃতার প্রারম্ভে মহারাজ বললেন, “আমার হাড় ivory-র মতাে সাদা ও গায়ের রং কালাে বলে চেতনানন্দ বলল, 'Ivory is covered with coal...।' ” আমি তাে ভয়ানক অপ্রস্তুত। পরে আমি বলেছিলাম, “আমি বললাম gold আপনি শুনলেন coal. You have embarrassed me in front of everybody.” “তাই নাকি?”—বলে তিনি হাে হাে করে হাসতে লাগলেন। সেই সরল হাসি কখনাে ভুলব না। আমার খেদ দূর হয়ে গেল।
No comments