প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী বােধাত্মানন্দ(ভব মহারাজ)(১৯০০-১৯৭৪), pracheen sadhu katha in bengali
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী বােধাত্মানন্দ(ভব মহারাজ)(১৯০০-১৯৭৪)
Sri
Ramakrishna
|
১৯৬৪
ও ১৯৬৫ সালে আমি বেলুড় মঠে
ট্রেনিং সেন্টারে ছিলাম তখন ভব মহারাজের ঘনিষ্ঠ
সান্নিধ্যে থাকবার সুযােগ
পেয়েছিলাম। পুরানাে ট্রেনিং সেন্টার। অ্যাসবেসটসের চালাঘর।
ডান দিকে দুটি ক্লাস ঘর বাঁ
দিকে ভব মহারাজের ঘর এবং
লাইব্রেরি। তার পাশের ঘরটা
মহারাজের সেবকের ঘর ও ভাণ্ডার।
সামনে ৫/৬টা
ঘর। প্রতি ঘরে তিন জন করে
ব্রহ্মচারী। আমার এবং আরাে
তিন জন ব্রহ্মচারীর ট্রেনিং
সেন্টারে থাকবার জায়গা হলাে
না। তাই আমরা চার জন বর্তমান
ট্রাস্টি বিল্ডিং-এর
ওপরের তলায় ডান দিকের প্রথম
ঘরে ছিলাম। বাথরুমের জন্য
Monks
Quarters-এ
যেতে হতাে। প্রতিদিন গঙ্গাস্নান
করতাম ও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—ঠাকুরের
মুখ না দেখে কারাে মুখ দেখব
না। দু-বছর
প্রতিদিন মঙ্গলারতিতে ঠাকুরকে
দর্শন করেছি। শীত ও বর্ষার
মধ্যেও মাত্র তিন-চার
দিন জ্বর হওয়ায় আমাকে Monks
Quarters-এ
থাকতে হয়েছিল—তাই মঙ্গলারতি
attend
করতে
পারিনি। তবে শঙ্খধ্বনি শুনে
ঠাকুরের চিন্তা করেছি। ভব
মহারাজ নিত্য মঙ্গলারতিতে
যেতেন। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে
মশারির মধ্যে বসে ধ্যানজপ
করতেন। বিকালে একটু বেড়িয়ে
এসে মশারির মধ্যে ধ্যানজপ
করতেন। বেলুড় মঠের মশাগুলি
সাধু-ভক্তদের
রক্ত চুষে খেয়ে মনে হয় মুক্ত
হয়ে গিয়েছে। এখন তাে মশা
নেই বললেই চলে।
একদিন
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“মহারাজ,
আপনার
ধ্যানজপের secret
আমাকে
একটু বলবেন।” তিনি বললেন,
“দেখ,
সন্ধ্যায়
ধ্যানজপের আগে আমি বিবেকচূড়ামণি-র
চারটি শ্লোক পড়ি এবং ঐগুলি
দিয়ে সারাদিনের নানাবিধ
চিন্তাকে নস্যাৎ করি। বিচারের
দ্বারা মনকে মায়ামুক্ত করে
ধ্যানজপ শুরু করি। সংসার
অনিত্য,
জগৎ
অনিত্য,
সুতরাং
তার problem-গুলিও
অনিত্য। মনকে অনিত্য দুশ্চিন্তা
দুর্ভাবনা থেকে সরিয়ে না
আনলে ধ্যানজপে মন বসে না।
ঠাকুরকে চিন্তা করলে মন সহজেই
শান্ত হয়।” তিনি আমাকে অনেক
বার মনঃসংযমের উপায় হিসাবে
পাতঞ্জল যােগদর্শন-এর
সমাধিপাদের ১২ নম্বর
সূত্র—‘অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং
তন্নিরােধঃ’-এর
কথা বলছেন। এই সূত্রের ওপর
ব্যাসভাষ্য হলাে—‘বৈরাগ্যেণ
বিষয়স্রোতঃ খিলীক্ৰিয়তে,
বিবেকদর্শনাভ্যাসেন
বিবেকস্রোত উদ্ঘাটতে'—বৈরাগ্যের
দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দ হয়,
আর
বিবেকদর্শন অভ্যাসের দ্বারা
বিবেকস্রোত খুলে যায়।
ব্যাসভাষ্যের ‘বিবেক’ ও
‘বৈরাগ্য'
শব্দ
দুটি তিনি আমাকে বহুবার
শুনিয়েছেন।
ট্রেনিং
সেন্টারে আমি কেবল ভব মহারাজ
ও পণ্ডিত মহারাজের (ব্রহ্মচারী মেধাচৈতন্য)
ক্লাসে
যেতাম। অন্যান্য বিষয়ের ওপর
আমি পরীক্ষা দিতাম,
কিন্তু
ক্লাসে যেতাম না,
কারণ
আমাকে exemption
দেওয়া
হয়েছিল।
Sri
Ramakrishna
|
ভব
মহারাজ আমাকে বলেন,
“তুমি
ঈশ,
কেন,
কঠ,
মুণ্ডক
উপনিষদ-গুলি
শাঙ্করভাষ্য,
আনন্দগিরির
টীকা ও শঙ্করানন্দের দীপিকাসহ
ঘরে পড়াে।” তাছাড়া তিনি
আমাকে ও রথীন মহারাজকে (স্বামী
জ্যোতীরূপানন্দ)
প্রতি
মঙ্গলবার ও শুক্রবার এক ঘণ্টা
করে বিবেকচূড়ামণি ও মাণ্ডুক্য
উপনিষদ কারিকা সহ পড়ান।
রাতে খাওয়ার পর রথীন মহারাজ
ও আমি পণ্ডিত মহারাজের কাছে
ন্যায় ও মীমাংসা পড়েছিলাম—সেগুলি
আমাদের curriculum-এ
ছিল না। ভব মহারাজ আমাদের
বেদান্তসার ও সাংখ্যকারিকা
পড়িয়েছিলেন। আমি বেদান্তসার-এর
note
রাখতাম।
তিনি পড়ে নিজ হাতে সেগুলি
সংশােধন করে দেন। সে খাতা
এখনাে আমার কাছে আছে।
ভব
মহারাজের মতাে শাস্ত্রের
অধ্যাপক বিরল। তিনি কেবল
শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না,
তিনি
ছিলেন সাধক সাধু। শাস্ত্র
পড়াবার কালে তিনি দেখিয়ে
দিতেন তার application-কীভাবে
ঠাকুর ও তাঁর সন্তানরা ঐগুলি
জীবনে প্রতিফলিত করেছেন। কী
দরদ দিয়ে পড়াতেন এবং পাঠ্যবস্তু
ছাত্রদের ভিতরে কীভাবে ঢুকিয়ে
দেওয়া যায় তার কৌশল তিনি
জানতেন।
Sri
Ramakrishna
|
তাঁর
diabetes
ও
high
blood pressure ছিল।
একদিন দেখলাম
তিনি সত্যিই অসুস্থ,
তা
সত্ত্বেও ক্লাসের আগে বেদান্তসার
পড়ছেন। আগে
তাঁর
চোখ থেকে চশমা নিয়ে নিলাম
এবং বললাম,
“আপনি
চল্লিশ বছর বেদান্ত পড়েছেন
এবং পড়িয়েছেন,
তবে
কেন আবার ক্লাসের জন্য premar,
করছেন?”
তিনি
আমায় বললেন,
“তুমি
আমার চশমা ফিরিয়ে দাও। দেখ তােমাকে একটা কথা বলি—আমি
শাস্ত্রের শব্দার্থ জানি,
তবে
ক্লাসের আগে ঐ বিষয়ের ওপর
মনন ও ধ্যান করলে আমি অনেক
নতুন তথ্য দেখতে পাই। ঐগুলি
নিয়ে আমি ক্লাসে ঢুকি। ঐসব
নতুন ভাব,
নতুন
আলাে আমাকে। ও ছাত্রদের
অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষকের
ভাসা-ভাসা
জ্ঞান ভাল নয়। তাতে ছাত্রদের
সামনে নিজের দৈন্য প্রকাশ
পায়। ভবিষ্যতে তুমি কখনও
প্রস্তুত না হয়ে বক্তৃতা ও
ক্লাস করতে যাবে না।” মহারাজের
এই অমূল্য উপদেশটি এখনাে আমি
পালন করি।
একদিন
উপনিষদের ক্লাসে পণ্ডিত মহারাজ
বললেন,
“ভব
মহারাজ শাস্ত্রজ্ঞ তপস্বী
সাধু। তিনি অবশ্যই ব্রহ্মলােকে
যাবেন।” আমি গিয়ে বললাম,
“মহারাজ,
আপনার
আর ধ্যানজপ করতে হবে না। পণ্ডিত
মহারাজ বলেছেন যে,
আপনি
ব্রহ্মলােকে যাবেন।” ভব মহারাজ
হেসে বললেন,
“পণ্ডিত
এই কথা বলেছে!
আচ্ছা,
তুমি
এখন পণ্ডিতকে গিয়ে বললা—সে
কোন্ লােকে যাবে?”
Sri
Ramakrishna
|
একদিন
বেদান্তের ক্লাসে শঙ্করের
মুক্তি ও বুদ্ধের নির্বাণের
মধ্যে পার্থকতা আছে কি না—তা
নিয়ে খুব বাদানুবাদ হলাে।
ভব মহারাজ একটা উদারন দিয়ে
তর্কের নিষ্পত্তি করে দিলেন।
তিনি বললেন,
“একটা
বড় জাহাজ বন্দর থেকে সমুদ্র
পাড়ি দেওয়ার জন্য ছাড়ল।
ঐ জাহাজে দুই যাত্রী শঙ্কর ও
বুদ্ধ। জাহাজ যখন তটভূমি ছেড়ে
গভীর সমুদ্রে চলে গেল—কূলকিনারা
আর দেখা গেল না,
বুদ্ধ
তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে
বললেন,
‘সর্বং
শূন্যং শূন্য। আর শঙ্কর নিচে
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘সর্বং
পূর্ণং পূর্ণম্। দেখ,
দু-জনে
একই স্থানে দাঁড়িয়ে একই
অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। বুদ্ধ
নির্বাণকে শূন্যরূপে দেখলেন,
আর
শঙ্কর মুক্তিকে পূর্ণরূপে
দেখলেন। বুদ্ধ negative
side-টা
দেখলেন আর শঙ্কর positive
side-টা
দেখলেন। দেখ,
একটা
অর্ধ জলপূর্ণ গ্লাসকে কেউ
বলে ‘half-empty',
আর
কেউ বলে ‘half-full',
কেউ
negative
side-টা
দেখে আর কেউ positive
side. তােমরা
জীবনে সবসময় positive
side-টা
দেখার চেষ্টা কোরাে।” কী
অপূর্ব যুক্তিযুক্ত সমাধান।
No comments