প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী শাশ্বতানন্দ(১৮৯৪-১৯৬৩)
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী শাশ্বতানন্দ(১৮৯৪-১৯৬৩)
Sri
Ramakrishna
|
স্বামী শাশ্বতানন্দ(সুরেশ মহারাজ)(১৮৯৪-১৯৬৩)
রবিবারে
অদ্বৈত আশ্রম বন্ধ থাকত,
তাই
প্রায় প্রতি রবিবার সকাল
থেকে সন্ধ্যারতি পর্যন্ত
বেলুড় মঠে কাটাতাম। ঐকালে
মঠে বহু প্রাচীন সাধু জীবিত
ছিলেন—যাঁরা মা,
স্বামীজী,
রাজা
মহারাজ ও মহাপুরুষ মহারাজের
শিষ্য। তাঁদের কাছে ঠাকুরের
সন্তানদের কত পুরানাে কথা
শুনেছি,
সেসব
যদি diary-তে
লিখে রাখতাম তাহলে একটা বিরাট
সম্পদ রক্ষিত হতাে। আমার
diary-তে
কিছু কিছু কথা লিখতাম যা আমাকে
অনুপ্রেরণা দিত।
স্বামী
শাশ্বতানন্দজী (সুরেশ
মহারাজ)
লেগেট
হাউসের দক্ষিণ দিকের ঘরে
থাকতেন। তিনি ছিলেন মঠ-মিশনের
assistant
secretary. লেগেট
হাউসের মাঝের ঘরে ট্রেনিং
সেন্টারের চার জন ব্রহ্মচারী
থাকতেন। মন্মথ মহারাজ
(সত্যব্রতানন্দজী)
তাঁদের
মধ্যে একজন। তিনি অদ্বৈত
আশ্রমের ব্রহ্মচারী ছিলেন।
আমি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছি
তখন স্বামী শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজ) বললেন,
“কী,
আজ
যে এখানে?”
“মহারাজ,
আজ
আমাদের holiday,
তাই
মঠে এসেছি।” “Holiday!
Holiday! সাধুজীবনে
holiday!
There is no moral holiday. তােমার
মুহূর্তের ভুলের জন্য ৩০ বছরের
তপস্যা নস্যাৎ হয়ে যেতে
পারে।” মহারাজের কথা শুনে
আমি ঘাবড়ে গেলাম। তখন সবে
join
(১৯৬০)
করেছি।
সুরেশ মহারাজের বাহ্যিক ভাব
কঠোর হলেও ভিতরটা খুব কোমল
ছিল। তিনি সবসময় সাধারণ
সাধু-ব্রহ্মচারীদের
খুব স্নেহের চক্ষে দেখতেন
এবং কোনাে মােহন্ত তাদের
বিরুদ্ধে কিছু বললে তিনি তাদের
সংশােধন করে সাহায্য করতেন।
মহারাজ
রােজ বিকালে ঠাকুরের মন্দিরের
পূর্বদিকের মাঠে পায়চারি
করতেন এবং যুবক সাধুদের জীবনগঠন
সম্বন্ধে বলতেন।
Sri
Ramakrishna
|
জুন
১৯৬০
মহারাজের
সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে আমি
জিজ্ঞাসা করলাম,
“বাইরের
লােকদের সঙ্গে আমাদের কীভাবে
মিশতে হবে?”
স্বামী
শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজ)
বললেন,
“যতটুকু
প্রয়ােজন ততটুকু। চারাগাছকে
প্রথমে বেড়া দিয়ে রাখতে
হয়;
পরে।
তার গুড়িতে গরু বেঁধে দিলেও
কিছু হয় না। এই মনে কর,
তােমাকে
একটা hospital-এ
worker
করে
পাঠানাে হলাে। তুমি সেখানে
emergency
ward-এ
dressing-এর
কাজ পেলে। কোনাে মেয়ের পা
হয়তাে তুমি রােজ পরিষ্কার
করে bandage
করছ।
তােমার কর্তব্য তুমি করবে—তাই
বলে কি তাকে তুমি রাতে প্রেমপত্র
লিখবে?”
স্বামী
শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজের
)এরকম
খােলামেলা কথা শুনে আমি হকচকিয়ে
গেলাম।
তারপর
বললেন,
“দেখ,
সাধুজীবন
আদর্শ জীবন। আদর্শকে ঠিক
রাখবে। প্রয়ােজনাতিরিক্ত
কিছু করতে যেয়াে না। নিজেকে
সর্বদা রক্ষা করবে।”
আর
একদিন ট্রেনিং সেন্টার সম্বন্ধে
বললেন,
“দেখ,
অনেক
মােহন্ত বেলুড় মঠের ট্রেনিং
সেন্টারের বিরােধী ছিল,
কারণ
তাদের কর্মীর অভাব। আমরা ঠিক
করলাম—দুটি বছর ছেলেদের কাজ
থেকে তুলে এনে ট্রেনিং সেন্টারে
কেবল শাস্ত্র অধ্যয়ন,
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ
সাহিত্য পাঠ ধ্যান ও জপ করার
সুযােগ দিতে হবে। তােমরা যদি
কিছু না জান তাহলে অপরকে শেখাবে
কী করে?
দেখছ
না,
ধনিব্যক্তিরা
তাদের ছেলেদেরকে রামকৃষ্ণ
মিশনের স্কুল-কলেজে
শিক্ষার জন্য পাঠায়। তারা
জানে যে,
এখানে
ভাল শিক্ষা পেলে তাদের ছেলেরা
তাদের সম্পত্তি রক্ষা করতে
পারবে। ঠিক তেমনি,
আমরা
যদি তােমাদের ভালভাবে ঠাকুরের
আদর্শে শিক্ষিত না করতে পারি,
তাহলে
তােমরা ঠাকুরের অধ্যাত্ম-সম্পদ
রক্ষা করতে পারবে না।”
Sri
Ramakrishna
|
তারপর,
ঠাকুর-স্বামীজীর
ভাব কীভাবে জগতে ছড়াতে হবে
সে-সম্বন্ধে
বলেন,
“দেখ,
তােমার
সিন্দুকে হিরে,
জহরত,
সােনা,
টাকা
রয়েছে। কিন্তু কেউ তা জানে
না। তাহলে ঐ গুপ্তধনের মূল্য
কী?
যক্ষের
ধন আগলে থাকো। সারা জীবন—তারপর
আসবে মৃত্যু। ঠাকুরের অমর ও
অমূল্য বাণী সারা জগতের কল্যাণের
জন্য ছড়াতে হবে।
“শােনাে
একটা ঘটনা। সুইজারল্যান্ড
থেকে এক ব্যক্তি ঘড়ি বিক্রির
জন্য বেরােল। তখন লােকে ঘড়ির
ব্যবহার জানত না। লােকটি
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘড়ি
distribute
করে
বলল,
তােমরা
ব্যবহার করাে। সময়ের মূল্য
কত তা বােঝে যদি তােমাদের
পছন্দ না হয় আমি ফেরার সময়
ঘড়ি নিয়ে নেব। তােমাদের
কোনাে টাকা দিতে হবে না। এক
বছর পরে ঘড়ি-বিক্রেতা
দেশে ফেরার কালে ঘড়ি ব্যবহারকারীদের
কাছে গিয়ে ঘড়ি ফেরত চাইলে
তারা ফেরত না দিয়ে ঘড়িগুলাে
কিনে নিল। তারা ঘড়ির মূল্য
বুঝল। অবশ্য দু-চার
জন ঘড়ি ফেরত দিল।
“তেমনি
ঠাকুর-স্বামীজীর
বাণী আমাদের সারা পৃথিবীতে
ছড়াতে হবে। কেউ নেবে,
কেউ-বা
নেবে না। ঠাকুরের ভাব ও বাণী
সমগ্র মানবের মঙ্গল। অবশ্যই
আনবে। ঠাকুরের ভাবে ভাবিত
আমাদের আদর্শ পবিত্র জীবন।
দেখলে তবে মানুষ অনুপ্রাণিত
হয়ে ঠাকুরের ভাব গ্রহণ করবে।”
স্বামী
শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজের)
সঙ্গে
তিন-চার
বছর সঙ্গ করবার সুযােগ হয়েছিল।
তিনি কট্টর বেদান্তী ছিলেন।
গৌড়পাদের অজাতবাদ খুব পছন্দ
করতেন। আমি কোনােদিন তাঁকে
ঠাকুরের মন্দিরে প্রণাম করতে
দেখিনি। এসব সাধুকে চেনা কঠিন।
তাঁরা অনেকে লােক-দেখানাে
ভক্তি প্রকাশ করেন না।
একদিন
আমাকে বলেন,
“দেখ,
আত্মা
মুক্ত—একথা টিকে না। আত্মা
বদ্ধও নন,
মুক্তও
নন। আত্মা কী,
বলা
যায় না। এ পৃথিবীতে যারা থাকে
তাদেরই রাত-দিনের
প্রশ্ন ওঠে,
সুখ-দুঃখ
প্রভৃতি দ্বন্দ্বাত্মক প্রশ্ন
ওঠে। কিন্তু যারা সূর্যে বাস
করে তারা অনাদিকাল থেকে
জ্যোতির্মণ্ডলে বাস করে আসছে।
তাদের কাছে সেই একাত্মক,
একরস
‘জ্যোতিঃ যে জ্যোতি—এ। বােধ
থাকে না। কারণ তাদের অন্ধকারের
কোনাে concept
নেই।”
১৯৬৩
সালের মে-জুনে
স্বামী শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজের)
heart-এর
problem
দেখা
দিল। তিনি কলকাতার P.G.
Hospital-এ
(এখন
শেঠ সুখলাল কারনানি হাসপাতাল)
ভর্তি
হন। আমি অদ্বৈত আশ্রম থেকে
প্রায়ই তাঁকে দেখতে যেতাম।
প্রয়ােজন হলে জামাকাপড়
কেচে দিতাম। একদিন ঠাট্টা
করে বললেন,
“দেখ,
আমার
heart-টা
এত বেড়ে গিয়েছে যে rib
cage আর
ধরে রাখতে পারছে না।”
তাঁর
টেবিলে দেখলাম শিল্পী N.
c. Das-এর
তৈরি ঠাকুর ও মায়ের ফটো।
প্রতি সন্ধ্যায় কয়েক জন
ভক্ত নার্স এসে খণ্ডন ভববন্ধন’
গাইত,
আর
মহারাজ চোখ বুজে শুনতেন। আমি
ভাবতাম,
সেই
কট্টর বেদান্তীর ভিতরে ঠাকুর
ও মা!
তারপর
একদিন আমায় বললেন,
“আমার
কাছে স্বামীজীর ফটো নেই। তুমি
N.
C. Das-এর
কাছ থেকে আমার নাম করে স্বামীজীর
একখানা ফটো আনতে পার?”
আমি
হাসপাতাল থেকে সােজা বৌবাজারে
N.
c. Das-এর
বাড়ি যাই। তিনি মহাপুরুষ
মহারাজের শিষ্য ছিলেন। স্বামী
শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজ)
স্বামীজীর
ফটো চেয়েছেন জেনে তিনি কী
খুশি। আমাকে N.
C. Das বললেন,
“আমি
কালই স্বামীজীর ছবি বাঁধিয়ে
মহারাজের কাছে পৌঁছে দেব।”
আমার
কাছে স্বামী শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজের)
কয়েকটি
চিঠি আছে। ঐ চিঠিগুলি স্বামী
অখিলানন্দ ও অন্যান্য সাধুকে
লেখা। দক্ষিণেশ্বরে সারদা
মঠের জমি কেনার ব্যাপারে তিনি
আমেরিকার সাধুদের কাছে
অর্থসাহায্য চান। স্বামীজীর
ইচ্ছা ছিল মেয়েদের মঠ হােক।
ঐ ইচ্ছা পূরণের জন্য স্বামী
শাশ্বতানন্দ(সুরেশ
মহারাজ)
খুব
খেটেছেন। এসব চিঠির ঐতিহাসিক
মূল্য আছে।
১৯৬৩
সাল। সারা পৃথিবীতে স্বামীজীর
জন্মশতবার্ষিকী উৎসব চলছে।
হাসপাতালে আমাকে একদিন বলেন,
“দেখ,
ডাক্তার
বলছে—আমার heart
enlarged হয়েছে।”
এটিই সাধুর লক্ষণ। হৃদয়বান
সাধু স্বামী শাশ্বতানন্দ
দেহত্যাগ করেন ২৭/৮/১৯৬৩
তারিখে। অপূর্ব সাধু!
No comments