প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী গহনানন্দ
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী গহনানন্দ
Sri
Ramakrishna
|
স্বামী গহনানন্দ (১৯১৬-২০০৭)
স্বামী
গহনানন্দজীর সঙ্গে আমার প্রথম
দেখা হয় ১৯৫৯-৬০
সালে।
তখন তিনি কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানেরসহ সম্পাদক।
সম্পাদক ছিলেন
স্বামী দয়ানন্দজী মহারাজ।
আমি তখন সবে অদ্বৈত আশ্রমে
যােগদান করেছি।
সেই সময়
অদ্বৈত আশ্রম ছিল ওয়েলিংটন
স্কোয়ারের (বর্তমানে
রাজা সুবােধ মল্লিক স্কোয়ার)
পূর্বদিকে
৪ ওয়েলিংটন লেনে।
আমাকে একবার
একটি পড়ার ফোড়ার চিকিৎসার জন্য
সেবা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছিল।
এখন যেখানে হাসপাতালের বিশাল
বাড়ি তখন সেই জায়গাটিতে
অ্যাসবেসটসের ছাদযুক্ত একটি
ঘর ছিল।
আমাকে বলা হলাে যে
অস্ত্রোপচার করতে হবে।
স্বামী
গহনানন্দজী ফোড়া অস্ত্রোপচারের
সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন।
তিনি মাঝে মাঝে অদ্বৈত আশ্রমে
আসতেন।
তাঁর সঙ্গ আমরা উপভােগ
করতাম।
আমার চোখে তিনি ছিলেন
একজন অসাধারণ কর্মী,
প্রখর
বাস্তববােধের অধিকারী,
অত্যন্ত
স্নেহপরায়ণ,
সহানুভূতি
সম্পন্ন এবং সমস্যা সমাধানে
দক্ষ একজন সাধু।
যে কেউই তাঁর
কাছে সাহায্য চাইত তিনি তাকে
সাহায্য করতেন।
গহনানন্দজী
ট্রাস্টি হওয়ার পর তিনি এবং
দয়ানন্দজী গাড়ি করে বেলুড়
মঠে ট্রাস্টি মিটিং-এ
যােগ দিতে যেতেন।
সেই সময়
অদ্বৈত আশ্রমের কোনাে গাড়ি
ছিল না।
তাঁরা সবসময় অদ্বৈত
আশ্রম থেকে স্বামী গম্ভীরানন্দজীকে
তুলে নিয়ে যেতেন এবং ফেরার
সময় পৌঁছে দিতেন,
এর
ব্যতিক্রম হলে গম্ভীরানন্দজী
বাসে করে যেতেন।
গহনানন্দজী
ছিলেন অক্লান্ত কর্মযােগী।
তাঁরই নেতৃত্বে এবং দায়িত্বে
বর্তমান হাসপাতালের বিশাল
বাড়িটি নির্মিত হয়।
আমার
মনে আছে।
জওহরলাল নেহরু (তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী)
এবং
শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত
বাড়িটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে
আসেন।
সাধুদের চিকিৎসার জন্য
প্রেমানন্দ ওয়ার্ড-টি
নির্দিষ্ট হয়।
এর আগে সাধুরা
অন্য রােগীদের সঙ্গে সাধারণ
ওয়ার্ডেই
থাকতেন।
পরবর্তিকালে স্নাতকোত্তর
বিভাগের উদ্বোধনের সময় মহারাজ
আমাকে ‘সেবা'
বিষয়ে
কিছু বলতে বলেন।
Sri
Ramakrishna
|
রামকৃষ্ণ মিশন সেবাকার্য
শুরু করে,
আমি
ছিলাম তার দায়িত্বে।
আমি
বেলুড় বিদ্যামন্দিরে গিয়ে
সেখানকার পুকুর থেকে একটি
নৌকা স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর
পাঠানাে ট্রাকে করে নিয়ে
আসি।
আমরা খিচুড়ি দেওয়ার
জন্য কয়েকটি বড় বড় ড্রাম
সংগ্রহ করি।
ওগুলি বেলুড়
মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের
নিচের গুদামে রাখা থাকত।
ঐ
নৌকাটিকে বস্তির মধ্যে আটকে
থাকা দুর্গত মানুষজনকে উদ্ধারের
কাজে লাগানাে হয়।
বেশিরভাগ
দুর্গত মানুষই সেই সময় স্থানীয়
একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তাঁদের বিশেষ প্রয়ােজন ছিল
খাদ্যের।
আমি গহনানন্দজীর
কাছে আমাদের কাজে সাহায্য
করার জন্য আবেদন করলাম।
তিনি
জিজ্ঞাসা করলেন,
“কতজন ঐ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন?”
আমি
বললাম,
“মহারাজ সমস্ত এলাকাই জলপ্লাবিত হয়েছে। বেশিরভাগ বস্তিবাসীই ঐ বিদ্যালয়টিতে আশ্রয় নিয়েছেন, তা আনুমানিক তিন-চারশাে তাে হবেই।”
তিনি শুনে বললেন,
“বেলা
দুটো নাগাদ ট্রাক আর ড্রামগুলি
সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসাে,
খিচুড়ি
তৈরি থাকবে তিনি
কম কথার মানুষ ছিলেন।
৩০ জন
নার্সিং ট্রেনিং স্কুলের
ছাত্রী হাসপাতালের কিচেনে
খিচুড়ি তৈরি করতে নিযুক্ত
করলেন।
বেলা ৩ টার মধ্যে খিচুড়ি
প্রস্তুত হয়ে গেল।
স্কুলে
আশ্রয় নেওয়া ক্ষুধার্ত
মানুষদের কাছে সেই গরম খিচুড়ি
পৌঁছে দেওয়া হলাে।
ক্ষুধার্ত
মানুষদের খাওয়ানাের এই আনন্দ
ছিল এক অপূর্ব অনুভূতি।
এটিই
আমার রিলিফের কাজের প্রথম
অভিজ্ঞতা।
দামােদর
ভ্যালি কর্পোরেশনের পক্ষ
থেকে প্লাবিত এলাকার জল সরানাের
জন্য বেশ কয়েকটি শক্তিশালী
পাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ওগুলি চালাতে ৪৪০ ভােল্টের
বিদ্যুৎ সংযােগ করতে হয়েছিল।
হঠাৎ সেই পাম্পগুলি বন্ধ হয়ে
যায় এবং দুর্ঘটনার ফলে একজন
কর্মী বৈদ্যুতিক শক লেগে
গুরুতর আহত হয়ে পড়েন।
আমি
দেখলাম অন্যান্য কর্মী তাঁকে
একটি কম্বল জড়িয়ে রাস্তার
ওপর শুইয়ে সারা দেহ ম্যাসেজ
করছেন—দেখে মনে হলাে তার
অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে আসছে।
সৈন্যবাহিনীর একটি দল তখন
টহল
দিচ্ছিল।
তাঁদের আধিকারিকের
কাছে গিয়ে কর্মীটির মরণাপন্ন
অবস্থার কথা বলে তাঁকে হাসপাতালে
পাঠানাের জন্য সাহায্য করতে
অনুরােধ করলাম।
আমাকে গেরুয়া
পরা সাধু দেখে তিনি সঙ্গে
সঙ্গে তাঁকে একটি জিপে করে
শিয়ালদার কাছে নীলরতন সরকার
হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন।
খুব আনন্দ হলাে।
ইতােমধ্যে
এক ব্যক্তি এসে জানালেন যে
স্কুলে আশ্রয় নেওয়া এক
আসন্নপ্রসবা মহিলার প্রসববেদনা
শুরু হয়েছে।
তিনি তাঁকে তখনি
কোনাে হাসপাতালে পাঠানাের
জন্য আমাদের সাহায্য চাইলেন।
আমি গহনানন্দজীকে ফোন করে
যােগাযােগ করার চেষ্টা করলাম
কিন্তু তিনি তখন একটি মিটিং-এ
থাকায় তাঁকে পাওয়া গেল না।
স্থানীয় কয়েক জন ঐ ভদ্রমহিলাকে
সঙ্গে সঙ্গে নীলরতন সরকার
হাসপাতালে নিয়ে গেল।
সেদিন
বিকালে গহনানন্দজীকে ঘটনাটি
জানাতে তিনি ভদ্রমহিলাকে
সেবা প্রতিষ্ঠানে পাঠানাের
জন্য আমাকে বকাবকি করলেন।
আমি বললাম,
“মহারাজ, আমি জানি অনেকসময় হাসপাতালের বেড ফাঁকা থাকে না, সেজন্যই আপনার অনুমতি ছাড়া আমি তাঁকে সেবা প্রতিষ্ঠানে পাঠাইনি।”
ঐ আসন্নপ্রসবা মহিলাকে আমরা
কোনাে সাহায্য করতে পারিনি
বলে তিনি খুব দুঃখিত হয়েছিলেন।
Sri
Ramakrishna
|
দুর্গতদের
আমরা দিনে একবার মাত্র কিছু
আহার্য দিতে পারছিলাম;
এজন্য
আমার মনে একটু খেদ ছিল।
সুর
এনামেল কোম্পানির মালিক শ্রী
সুর একদিন অদ্বৈত আশ্রমে এসে
আমাদের এই সেবাকার্যে কিছু
সাহায্য করতে চাইলেন।
আমি
তাঁকে বললাম,
“আমরা দুর্গতদের মাত্র একবেলার খাবার দিতে পারছি। রাত্রে তাঁদের খাওয়ার মতাে কিছুই থাকে না; আর ওখানে বেশকিছু শিশু ও অসুস্থ মানুষও আশ্রয় নিয়েছেন। অন্তত ২০০টি পাঁউরুটি বিকালে পেলে তাঁদের কাছে রাতের কিছুটা খাবার পৌঁছে দিতে পারা যায়।”
শ্রী
সুর সঙ্গে সঙ্গে ধর্মতলায়
বড়ুয়া বেকারির সঙ্গে যােগাযােগ
করলেন,
সেখান
থেকে বিকাল ৫টায় একটি জিপে
করে সদ্য তৈরি গরম পাঁউরুটি
এল এবং আমরা সেগুলি স্কুলে
আশ্রিত দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ
করে দিলাম।
একদিন
আমরা নৌকা করে সেসব জায়গায়
দুপুরে খাবার দিতে গেলে সেখানকার
কিছু লােকজন আমাদের দেখে
তাঁদের উদ্ধার করার জন্য আর্জি
জানাতে
থাকেন,
কারণ
ইতােমধ্যে তাঁদের ঘরেও জল
ঢুকতে আরম্ভ করেছে।
আমরা
চার-পাঁচ
দিন ধরে এই সেবাকার্য চালাই।
গহনানন্দজী রান্না করা খাবার
পাঠানাের ব্যবস্থা করেছিলেন
এবং প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলায়
আমাদের কী প্রয়ােজন সে-সম্পর্কে
খোঁজখবর নিতেন।
বেলুড় মঠের
ত্রাণ বিভাগ থেকেও অন্যান্য
সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছিল।
আমার মনে আছে,
ভূতেশানন্দজী
আমাকে সবকিছুর হিসাব রাখতে
বলেছিলেন।
স্থানীয় লােকদের
কাছ থেকে আমরা কিছু টাকা,
জামাকাপড়,
চাল,
সবজি
সংগ্রহ করেছিলাম।
তখন নকশাল
আন্দোলনের কারণে ভয়ে খুব কম
মানুষ বাইরে বেরােতেন।
ঐ দলের
কয়েক জন যুবকের সঙ্গে আমার
পরিচয় ছিল।
আমি তাদের কিছু
অর্থ এবং চাল দিয়ে দুর্গতদের
সেবা করতে বলেছিলাম।
সবসময়ই গহনানন্দজী
আমাকে অন্তত একদিন হলেও সেবা
প্রতিষ্ঠান থাকবার জন্য
আমন্ত্রণ করতেন।
আমি লক্ষ্য
করেছি,
তিনি
সকালে জপধ্যানের পর গীতা বা
উপনিষদ পাঠ করতেন।
তারপর
জলখাবার খেয়ে হাসপাতালে
যেতেন।
দুপুরে দেরি করে খেতেন।
তারপর একটু বিশ্রাম করে রাত
দশটা পর্যন্ত কাজ করতেন।
বেশি
রাত পর্যন্ত জেগে থাকা তাঁর
অভ্যাস ছিল।
একবার কর্মীদের
ধর্মঘটের সময় তিনি অন্যান্য
সাধুর সাহায্যে দৃঢ়তার সঙ্গে
পরিস্থিতির মােকাবিলা করেছিলেন।
Sri
Ramakrishna
|
পাশ্চাত্যের
কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে
গহনানন্দজীর গভীর আগ্রহ ছিল।
আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে
কথা হতাে এবং কীভাবে সংঘের
ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়
সে-বিষয়েও
আলােচনা হতাে।
একবার সেবা
প্রতিষ্ঠানের সাহায্যকল্পে
রবীন্দ্র সদনে ‘ভীষ্ম’ পালাটি
অভিনীত হয়।
মহারাজ আমাকে
তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেই
চমৎকার অভিনয় দেখেন।
১৯৯৩
সালে শিকাগাে ধর্মমহাসভার
শতবর্ষপূর্তি উৎসবে যােগ
দিতে মহারাজ আমেরিকায় আসেন।
শিকাগাের রিট্রিট সেন্টার
(নির্জন
সাধন কেন্দ্র)
গ্যাঞ্জেস'-এ
তাঁর নেতৃত্বে এক সাধু-সম্মেলন
হয়।
সেখানে পাশ্চাত্যে আমাদের
কাজ সম্পর্কে নানা বিষয়ে
আলােচনা হয়।
তিনি আরাে বহু
কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এবং
সেন্ট লুইস কেন্দ্রে আয়ােজিত
আন্তঃধর্ম সম্মেলনেও যােগ
দেন।
বাংলাদেশে অবস্থিত
কেন্দ্রগুলির অবস্থা সম্পর্কে
তিনি গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন।
তিনি আমায় বলেন যে,
ভারত
থেকে ঐ কেন্দ্রগুলিকে সাহায্য
করা সম্ভব নয়।
তিনি আমাকে
আমেরিকা থেকে ঐ কেন্দ্রগুলিকে
সাহায্য করার কথা বলেন।
আমার
মনে আছে,
তিনি
যখন সহ-সভঘাধ্যক্ষ
হয়ে কাঁকুড়গাছিতে ছিলেন,
সেসময়
আশ্রম সংলগ্ন বন্ধ হয়ে যাওয়া
টাটা সােপ ফ্যাক্টরির জমি
কেনার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা
চালান।
তিনি সাহায্যের জন্য
আবেদন জানালে আমি কিছু অর্থ
পাঠিয়েছিলাম।
তাঁর দূরদৃষ্টির
জন্যই ঐ জমিটি মঠের অধিকারে
আসে।
আমি
তাঁকে কখনও হিমালয়ে তপস্যা
করতে যেতে দেখিনি।
সারাজীবন
শ্রীশ্রীঠাকুর ও স্বামীজীর
কাজ করার মধ্য দিয়েই তিনি
তপস্যা করে গিয়েছেন।
তিনি
যখন সাধারণ সম্পাদক,
তখন
দেখেছি,
মন্দিরে
সন্ধ্যারতিতে যােগ না দিয়ে
তিনি কলকাতায় উকিলের বাড়ি
যাচ্ছেন।
কাজই ছিল তাঁর কাছে
পূজা।
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে তাঁর
অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
No comments