প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী সারদেশানন্দ (১৮৯৪-১৯৮৮) Prācīna sādhudēra kathā
স্বামী সারদেশানন্দ (১৮৯৪-১৯৮৮)
স্বামী
সারদেশানন্দজীর সঙ্গে পরিচয়
তাঁর শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব
গ্রন্থের মাধ্যমে। কলকাতা
অদ্বৈত আশ্রমে tradition
ছিল—রাতে
খাওয়ার পর সব সাধু ও ব্রহ্মচারীর
সামনে যে-ব্রহ্মচারী
সবে join
করেছে
তাকে পাঠ করতে হতাে এবং যে বই
নতুন বেরিয়েছে তা-ই
পাঠ্য ছিল। এই পাঠ ১৫/২০
মিনিট ধরে হতাে। ১৯৫৯-৬০
সালে সারদেশানন্দজীর লেখা
চৈতন্যদেবের জীবনী শুনে খুব
অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এবং
রঘুনাথের প্রতি চৈতন্যদেবের
উপদেশ মুখস্থ করেছিলাম
—“গ্রাম্যবার্তা
না শুনিবে গ্রাম্যবার্তা না
কহিবে।
ভাল
না খাইবে আর ভাল না পরিবে।
অমানী
মানদ কৃষ্ণনাম সদা লবে।
ব্রজে
রাধাকৃষ্ণ সেবা মানসে করিবে।”
১৯৫৯
সালে আমি যখন বৃন্দাবনে পুরানাে
আশ্রমে গিয়েছিলাম তখন
সারদেশানন্দজী সেখানে ছিলেন
না। ১৯৭৭-এর
সেপ্টেম্বরে আমি যখন হলিউড
থেকে বৃন্দাবনে যাই তখন মহারাজের
সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁর
ত্যাগ-বৈরাগ্য,
সাধন-ভজন
ও পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হই।
শ্রীশ্রীমায়ের শিষ্য ও তাঁর
হাতেগড়া সাধুটি বহু সাধু,
ব্রহ্মচারী
ও ভক্তের মনে আনন্দ ও উদ্দীপনা
জাগাতেন। তিনি সত্যই গুণী ও
আদর্শ সাধু ছিলেন। আমি কোনাে
সাধুর ঘরে গেলে তাঁর সম্পত্তি—বই,
ছবি
প্রভৃতি দেখি।
মহারাজের ঘরে দেখলাম— খাটের ওপর দু-তিন ভাঁজ করা একটি কম্বলের ওপর একটা গেরুয়া চাদর, একটা ছােট বালিশ, একটা ছােট টেবিল ফ্যান মাথার কাছে; খাটের একপাশে কয়েকটি বই, একটা ছাতা, একখানা লাঠি, এক জোড়া স্যান্ডেল, দু-তিনটি ছােট কাপড় ও চাদর; টেবিলে ঠাকুর ও মায়ের ছবি; একটা জলের কুঁজো, একটা বড় বাটি—যা তিনি খাওয়ার সময় ডাইনিং হলে নিয়ে যেতেন। আমরা একসঙ্গে খেতাম। তাঁর জন্য কোণায় একটা নির্দিষ্ট স্থান ছিল। ভাত, ডাল, তরকারি সবকিছু চটকে মণ্ডের মতাে করে খেতেন। কারণ, তাঁর প্রায় সব দাঁতই পড়ে গিয়েছিল। খাওয়ার পর তিনি নিজের বাটি নিজে ধুয়ে ঘরে নিয়ে যেতেন। তিনি যখন মন্দিরে ছিলেন, তখন তাঁর ঘরের একটি ছবি নিয়েছিলাম।
মহারাজের ঘরে দেখলাম— খাটের ওপর দু-তিন ভাঁজ করা একটি কম্বলের ওপর একটা গেরুয়া চাদর, একটা ছােট বালিশ, একটা ছােট টেবিল ফ্যান মাথার কাছে; খাটের একপাশে কয়েকটি বই, একটা ছাতা, একখানা লাঠি, এক জোড়া স্যান্ডেল, দু-তিনটি ছােট কাপড় ও চাদর; টেবিলে ঠাকুর ও মায়ের ছবি; একটা জলের কুঁজো, একটা বড় বাটি—যা তিনি খাওয়ার সময় ডাইনিং হলে নিয়ে যেতেন। আমরা একসঙ্গে খেতাম। তাঁর জন্য কোণায় একটা নির্দিষ্ট স্থান ছিল। ভাত, ডাল, তরকারি সবকিছু চটকে মণ্ডের মতাে করে খেতেন। কারণ, তাঁর প্রায় সব দাঁতই পড়ে গিয়েছিল। খাওয়ার পর তিনি নিজের বাটি নিজে ধুয়ে ঘরে নিয়ে যেতেন। তিনি যখন মন্দিরে ছিলেন, তখন তাঁর ঘরের একটি ছবি নিয়েছিলাম।
মহারাজের
সম্পত্তি মহাত্মা গান্ধির
মৃত্যুর পর তাঁর ঘরে কী ছিল
তা মনে করিয়ে দেয়। গান্ধিজীর
ঘরে পাওয়া যায়—এক জোড়া
কাঠের ও এক জোড়া চামড়ার
স্যান্ডেল,
একটা
পকেট ঘড়ি,
চিঠি
খুলবার একটা ছুরি,
একটা
পিকদানি,
একটা
চশমা,
একটি
গীতা,
একটা
সাদা ও একটা কালাে বাটি ও একটা
চামচ এবং মুখে হাত,
কানে
হাত ও চোখে হাত দেওয়া তিন বানরের মূর্তি এ জগতে সবাই
বৈরাগ্যবান ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা
করে। কারণ ‘বৈরাগ্যমেব
অভয়’বৈরাগ্যই মানুষকে ভয়হীন
করে।
মহারাজ
রাতে খাওয়ার পর লাইব্রেরিতে
ক্লাসে এসে বসতেন। একজন সাধু
জিজ্ঞাসা করেন,
“আজ
কি ক্লাস হবে?”
মহারাজ
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,
“কই,
খাওয়ার
আগে তাে বললে না—আজ কি খাওয়া
হবে?”
ক্লাস
হলাে। তারপর বললেন,
“ক্লাসের
বদলে চেতনানন্দের কাছ থেকে
ওদেশের খবর শুনলে বেশ হতাে।”
পরে মহারাজ আমাকে জিজ্ঞাসা
করেছিলেন,
“তােমরা
ওদেশে কী কর?”
আমি
আমাদের হলিউড কেন্দ্রের
routine “ বললাম, “সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় ধ্যান হয়। Nun-রা পূজা করে। তারপর যে যার কাজ করে। আমেরিকায় আমাদের কোনাে রাঁধুনি, চাকর নেই– হাটবাজার করা, রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সব কাজ নিজেদের করতে হয়। সপ্তাহে দু-দিন ক্লাস ও রবিবারে বক্তৃতা হয়।” তিনি সব শুনে বলেন, “দেখ, তােমরা ওদের বেদান্ত শেখাও—ভাল, কীভাবে আদর্শ গৃহী হওয়া যায় সেটাও ওদের বােলাে। ওদের মধ্যে এত divorce যে family life ভেঙেচুরে পড়ছে। ছেলেমেয়ের প্রতি ভালবাসা বাড়লে এই divorce কমবে, সংসারে শান্তি আসবে।”
আমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম, মায়ের এক বৃদ্ধ সন্তান আমেরিকানদের কীভাবে মঙ্গল হয় তার চিন্তা করছেন। ১৪/৯/১৯৭৭, বৃন্দাবন।
সারদেশানন্দজীর সঙ্গে মঠ-মিশনের কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা হয়। এ-সময় যদিও তিনি কোনাে কর্মে যুক্ত ছিলেন না, তবুও সংঘে সদা কল্যাণচিন্তা করতেন। জাহাজের দিগদর্শনের কম্পাসের মতাে তিনি সাধুদের লক্ষ্য দেখিয়ে দিতেন। আমার diary-তে সংক্ষেপে অনেক কিছু লিখেছিলাম।
মহারাজের একটা কথা খুব মনে আছে ঃ “মহাপুরুষ মহারাজ একজন সাধুকে কাজ করতে বলেন। সে বলল, “ভগবানলাভ জীবনের উদ্দেশ্য, কাজ নয়। মহাপুরুষ মহারাজ রেগে বলেছিলেন, স্বামীজী বলেছেন যে ঠাকুরের কাজ করে চিত্তশুদ্ধির দ্বারা মুক্তি হবে। তবে কি তুমি বলতে চাও, স্বামীজী জোচ্চোর ছিলেন? ”
সেই রাতে মহারাজ আমাকে বলেছিলেন, “যদি ভগবানদর্শন করতে চাও, তবে বিশ্বাস রাখাে, আর তাঁর ইচ্ছায় নিজেকে সঁপে দাও।” আরাে বলেছিলেন, “Selfishness খারাপ, কারণ ওটিই বন্ধন। তবে selfprotection দরকার। দেখ, নিত্য সাধন-ভজন অভ্যাসের মূল্য খুব বিেশ। মনকে একাগ্র করে যােগ করাে।”
মহারাজের একটা কথা খুব মনে আছে ঃ “মহাপুরুষ মহারাজ একজন সাধুকে কাজ করতে বলেন। সে বলল, “ভগবানলাভ জীবনের উদ্দেশ্য, কাজ নয়। মহাপুরুষ মহারাজ রেগে বলেছিলেন, স্বামীজী বলেছেন যে ঠাকুরের কাজ করে চিত্তশুদ্ধির দ্বারা মুক্তি হবে। তবে কি তুমি বলতে চাও, স্বামীজী জোচ্চোর ছিলেন? ”
সেই রাতে মহারাজ আমাকে বলেছিলেন, “যদি ভগবানদর্শন করতে চাও, তবে বিশ্বাস রাখাে, আর তাঁর ইচ্ছায় নিজেকে সঁপে দাও।” আরাে বলেছিলেন, “Selfishness খারাপ, কারণ ওটিই বন্ধন। তবে selfprotection দরকার। দেখ, নিত্য সাধন-ভজন অভ্যাসের মূল্য খুব বিেশ। মনকে একাগ্র করে যােগ করাে।”
আগের
দিন তিনি আমাকে বলেছিলেন
সাধুজীবনে তিনটি আবশ্যকীয় বিষয়
ঃ
“এক, চরিত্র-
চরিত্র গঠিত হয় যম—অহিংসা, সত্য, অস্তেয় বড় ও অপরিগ্রহ এবং নিয়ম—শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধানেন দ্বারা। সাধুর আদর্শ-চরিত্রই মানুষকে শিক্ষা দেয়।
দুই, বিশ্বাস ও ভক্তি। সাধুজীবনে ভগবানে বিশ্বাস ও ভক্তি অপরিহার্য। শুধু বিশ্বাস-ভক্তি থাকলেই হবে না। কাজে দেখাতে হবে।
তিন, পরার্থপরতা। নিজেকে অপরের সেবায় সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দাও। মানুষের প্রতি ভালবাসা ও সেবা স্বার্থপরতা-রূপ বন্ধন ধ্বংস করে। সাধুর জীবনই হচ্ছে সবথেকে বড় প্রচার।” মহারাজ বলতেন—রােজ ভাগবত পড়লে ঈশ্বরে ভক্তি হয়।
“এক, চরিত্র-
চরিত্র গঠিত হয় যম—অহিংসা, সত্য, অস্তেয় বড় ও অপরিগ্রহ এবং নিয়ম—শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধানেন দ্বারা। সাধুর আদর্শ-চরিত্রই মানুষকে শিক্ষা দেয়।
দুই, বিশ্বাস ও ভক্তি। সাধুজীবনে ভগবানে বিশ্বাস ও ভক্তি অপরিহার্য। শুধু বিশ্বাস-ভক্তি থাকলেই হবে না। কাজে দেখাতে হবে।
তিন, পরার্থপরতা। নিজেকে অপরের সেবায় সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দাও। মানুষের প্রতি ভালবাসা ও সেবা স্বার্থপরতা-রূপ বন্ধন ধ্বংস করে। সাধুর জীবনই হচ্ছে সবথেকে বড় প্রচার।” মহারাজ বলতেন—রােজ ভাগবত পড়লে ঈশ্বরে ভক্তি হয়।
তিনি
আমাকে আরাে দুটি জিনিস বলেছিলেন,
“এক, ঠাকুরের ভাব প্রচার। এ যুগে ঠাকুরের বিশ্বজনীন উদার ভাব যত প্রচার হবে তত মানবের কল্যাণ হবে। ধর্ম নিয়ে হিংসা, দ্বেষ ও মারামারি কমবে।
দুই, গার্হস্থ্যধর্মের উন্নয়ন। গৃহীরাই সমাজের বনিয়াদ। গার্হস্থ্যজীবন shaky হলে সমাজ shaky হয়। গৃহীরা যদি ধার্মিক হয়, ছেলেমেয়েরাও সেরূপ হওয়ার সুযােগ পায়।” আমার মনে আছে, একজন সাধু গৃহীদের একটু নিচু চোখে দেখত অন্য এক সাধু তাকে বলেন, “আরে সন্ন্যাসীরা তাে গৃহীদের পেট থেকেই জন্মায়। সন্ন্যাসীর পেট থেকে তাে সন্ন্যাসী হয় না।”
“এক, ঠাকুরের ভাব প্রচার। এ যুগে ঠাকুরের বিশ্বজনীন উদার ভাব যত প্রচার হবে তত মানবের কল্যাণ হবে। ধর্ম নিয়ে হিংসা, দ্বেষ ও মারামারি কমবে।
দুই, গার্হস্থ্যধর্মের উন্নয়ন। গৃহীরাই সমাজের বনিয়াদ। গার্হস্থ্যজীবন shaky হলে সমাজ shaky হয়। গৃহীরা যদি ধার্মিক হয়, ছেলেমেয়েরাও সেরূপ হওয়ার সুযােগ পায়।” আমার মনে আছে, একজন সাধু গৃহীদের একটু নিচু চোখে দেখত অন্য এক সাধু তাকে বলেন, “আরে সন্ন্যাসীরা তাে গৃহীদের পেট থেকেই জন্মায়। সন্ন্যাসীর পেট থেকে তাে সন্ন্যাসী হয় না।”
No comments