প্রাচীন সাধুদের কথা
স্বামী শঙ্করানন্দ (১৮৮০-১৯৬২)
সমুদ্রের
ঢেউ-এর
মতাে মনুষ্যমনে অসংখ্য বৃত্তি
ওঠে ও বিলীন হয়। এই বিলুপ্ত
বৃত্তিগুলি চিত্তে স্মৃতিরূপে
থেকে যায়। বৃত্তি জোরালাে
হলে স্মৃতিও গভীরভাবে দাগ
কাটে এবং অম্লান থাকে। মহৎ
ব্যক্তিদের মহত্ত্বের ও
ব্যক্তিত্বের এতই প্রভাব যে,
তাঁদের
একবার দর্শন করলেও চিরকাল
মনে থাকে। যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণ,
শ্রীশ্রীমা
ও স্বামীজীকে ক্ষণিক দর্শন
করেছেন,
তাঁদের
সেই অমূল্য স্মৃতি চিরকাল
মানসপটে অমর হয়ে রয়েছে।
স্বামী শঙ্করানন্দজীকে অনেক
বার দর্শন করেছি,
কিন্তু
ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযােগ
হয়নি। দীর্ঘকালের ব্যবধানে
মহারাজের বিক্ষিপ্ত স্মৃতিগুলির
রূপ দেওয়ার ইচ্ছা জাগল।
দেবতার বেদিতে একটা ছােট ফুল
তুচ্ছ হতে পারে,
কিন্তু
বহু ছােট ফুলের সমষ্টিতে যখন
একটা মালা তৈরি হয় তা দেবতার
গলায় সুন্দর দেখায়।
আমি শঙ্করানন্দজীকে প্রথম দর্শন করি ১৯৫৫ সালে স্বামীজীর জন্মদিনে। বিকালে মহারাজ মঠপ্রাঙ্গণে এলে আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলাম এবং তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বপূর্ণ মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি তখন কলেজে পড়ি। তারপর জীবনের পথে চলার উপদেশ প্রার্থনা করে মহারাজকে চিঠি দিয়েছিলাম। তাঁর সেক্রেটারি স্বামী সুপর্ণানন্দ সে-চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। তারপর ১৯৫৮ সালে আমি অদ্বৈত আশ্রমে যােগ দিই। প্রায় প্রতি রবিবার বেলুড় মঠে যেতাম এবং মহারাজকে দর্শন করতাম। অনেকসময় মঠ থেকে অদ্বৈত আশ্রমে ফোন আসত মহারাজের ঔষধের জন্য। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে হিন্দ সিনেমার পাশে L. M. Mukherjee-র ঔষধের দোকান ছিল। এই মুখার্জি পরিবার মহারাজের ভক্ত ছিল। আমি ঔষধ নিয়ে সন্ধ্যায় মঠে যেতাম এবং মহারাজকে আরতির আগে দর্শন করে ৯টার ভিতর অদ্বৈত আশ্রমে ফিরে আসতাম। দেখতাম মহারাজ গম্ভীরভাবে একটা চেয়ারে বসে থাকতেন এবং সাধু ও ভক্তেরা দরজার কাছ থেকে প্রণাম করতেন। ঐ কালে একদিন মহারাজের কণ্ঠস্বর শােনার সুযােগ হয়েছিল। আমি ছিলাম অপুদা মহারাজের(স্বামী যােগীশ্বরানন্দ) পিছনে। হঠাৎ মহারাজ গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, “অপুদা, আজ যে!” অপুদা বললেন, “মহারাজ, আমি আপনার গােলাম।” “অপুদা, আমিও আপনার গােলাম।” অপুদা তাঁর স্বভাবসিদ্ধভাবে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে লাগলেন,
- “মহারাজ, আমি আপনার গােলাম,
- আমি আপনার গােলাম,
- আমি আপনার গােলাম।”
ঐ দুই প্রাচীন সাধুর বিনয় ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ আলাপ শুনে আনন্দ পেয়েছিলাম।।
No comments