প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ঈশানানন্দ (বরদা মহারাজ)
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ঈশানানন্দ (১৮৯৮-১৯৭৪)
Sri
Ramakrishna
|
স্বামী
ঈশানানন্দ(১৮৯৮-১৯৭৪)।
স্বামী
ঈশানানন্দজীকে (বরদা
মহারাজ) আমি
ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৩-৫৪
সালে খুব সম্ভব শ্রীশ্রীমায়ের
জন্মশতবার্ষিকীর সময় দর্শন
করি।
আমি তখন মায়ের বাড়ীর
volunteer
ছিলাম।
গায়ে একটা পাতলা গেরুয়া
চাদর,
গলায়
রুদ্রাক্ষের মালা–মায়ের
বাড়ীতে ঘােরাফেরা করছেন
একটা বালকের মতাে।
ইনি খুব
ভাগ্যবান সাধু।
এগারাে বছর
বয়সে মায়ের কাছে এসেছেন,
দীক্ষালাভ
করেছেন এবং পরবর্তী এগারাে
বছর অর্থাৎ মায়ের দেহত্যাগ
পর্যন্ত সেবকরূপে থেকেছেন।
তিনি খুব সরল সাদাসিধে সাধু
ছিলেন।
১৯৬১-৬২
সালে তিনি এন্টালিতে অদ্বৈত
আশ্রমে আসেন।
রবিবারের এক
বিকালে তিনি মায়ের কথা বলেন।
আমি তখন ব্রহ্মচারী,
বক্তৃতার
sound
system দেখার
ভার আমার ওপর ছিল।
তখন বক্তৃতার
রেকর্ড হতাে না,
কেবল
loud
speaker ছিল।
মহারাজ কখনাে চোখ মেলে আবার
কখনাে চোখ বুজে সােজা বাঁকুড়ার
ভাষায় দিব্যি মায়ের কথা
বলে যেতেন।
লােক মুগ্ধ হয়ে
প্রত্যক্ষদর্শীর সব বিবরণ
শুনত।
তিনি মায়ের হলােনি',
'হবে',
করবেক’,
‘যাবােনি
ইত্যাদি শব্দ এমনভাবে বলতেন
যেন মা-ই
বলছেন।
Sri
Ramakrishna
|
তখন তাঁর
ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার আমার
সুযােগ হয়।
তাঁর সঙ্গে দুটি
জিনিস থাকত—মায়ের একটি ফটো
album
এবং
মায়ের একটি চরণচিহ্ন—পিচবাের্ডে
পিন দিয়ে আঁটা ও লাল শালু
দিয়ে মােড়া।
আমি তখন অদ্বৈত
আশ্রমে ফটো বিভাগ দেখাশােনা
করতাম। প্রথমে album-টির
ইতিহাস বলি।
ওতে মায়ের অধিকাংশ
ছবি,
হাতের
ছাপ,
পায়ের
ছাপ সহ মােট ৩৬টি ফটো আছে।
খুব
সম্ভব এই album
ব্রহ্মচারী
গণেনের তৈরি,
কারণ
তিনিই মায়ের অধিকাংশ ছবি
তুলেছিলেন।
ঐ album-টি
এখন বেলুড় মঠ লাইব্রেরিতে
আছে।
১৯৮৮ সালে স্বামী
হিরন্ময়ানন্দজী যখন General
Secretary ছিলেন
তখন তিনি তা।
আমেরিকায় নিয়ে
আসেন।
১২/৬/১৯৮৮
তারিখে আমি St.
Louis-এ
তা xerox
করে
রেখে দিয়েছি।
কারণ এতে বহু
history
রয়েছে।।
১৯৬৮
সালে বরদা মহারাজ আমাকে মায়ের
সর্বত্র পূজিত ফটোর (shrine
pose) original ছবি
দেখান,
যা
নিবেদিতার কাছে ছিল।
আমি তাঁকে
ঐ ছবি অদ্বৈত আশ্রমকে দিতে
বললাম।
তিনি প্রথমে রাজি হননি।
শেষে বললেন,
“তােমাদের প্রেসিডেন্ট যদি গ্যারান্টি দেয় তাহলে দেব।”
স্বামী
বুধানন্দজী তখন অদ্বৈত আশ্রমের
প্রেসিডেন্ট।
আমি তাঁকে সব
জানালে তিনি মহারাজকে ঐ original
ছবি
preserve
করবার
প্রতিশ্রুতি দেন।
আমি ঐ original
থেকে
অনেক negative
করে
রেখেছি এবং পরে এদেশে এনে
রেখেছি।
ঐ original
ছবির
ফটো আমরা বিক্রি করি।
১৯৬৯-৭০
সালে দেখলাম,
মায়ের
শিষ্যেরা সব একে একে চলে
যাচ্ছেন।
এঁরা চলে গেলে অনেক
প্রত্যক্ষদর্শীর ইতিহাস
বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তখন কাশীতে
মায়ের বেশকিছু শিষ্য ছিলেন—
- যেমন বরদা মহারাজ,
- বৈকুণ্ঠ মহারাজ,
- ধরণী মহারাজ,
- অপূর্বানন্দজী প্রমুখ।
আমি অদ্বৈত আশ্রম
থেকে মায়ের ৩৫টি ছােট ফটো
বরদা মহারাজের কাছে পাঠালাম।
তিনি ঐসব ফটোর পিছনে নম্বর
দিয়ে।
এবং ছােট কাগজে সেই
নম্বর দিয়ে প্রতি ছবির
ইতিহাস—কোথায় তােলা,
কখন
তােলা,
গ্রুপ
ফটোতে ব্যক্তি-পরিচিতি
দিয়ে লিখে আমাকে পাঠান।
ঐসব
ফটো ও বরদা মহারাজের note-এর
ওপর নির্ভর করে আমরা album
তৈরি
করেছি।
তা রামকৃষ্ণ মিশনের
একটা সম্পদ হয়ে রয়েছে।
বরদা
মহারাজের হাতে লেখা নােট সহ
ছবিগুলি এখনাে আমার কাছে আছে।
-
এবার
মায়ের footprint-এর
কথা বলি।
১৯১৯ সালে কোয়ালপাড়ায়
মা বরদা মহারাজকে দিয়ে কোতুলপুর
থেকে কাপড় ও আলতা কিনিয়ে
৩২টি পায়ের ছাপ দেন।
এগুলিই
জীবিতাবস্থায় নেওয়া তাঁর
শেষ পায়ের ছাপ মা নিজে বরদা
মহারাজকে একটি দেন এবং সেটিই
বাের্ডে এঁটে লাল শালু দিয়ে
মুড়ে নিয়ে তিনি সর্বত্র
যেতেন।
বরদা মহারাজের দেহত্যাগ
হয় কাশী অদ্বৈত আশ্রমে ১৯৭৪
সালে।
১৯৮৬ সালে আমি ভারতে
যাই এবং রজনী মহারাজের কাছে
মায়ের ঐ পায়ের ছাপ দেখি।
আমি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা
করলে তিনি তা
আমাকে দেন।
আমি ঐ জীর্ণ চরণচিহ্ন
acid
free কাপড়
পিছনে দিয়ে।
সংরক্ষণ করে
St.
Louis-এর
ঠাকুরঘরে ঠাকুরের বেদির নিচে
রেখে দিয়েছি।
Sri
Ramakrishna
|
আবার
আমরা বরদা মহারাজের কথায়
ফিরে যাই।
১৯৬৮ সালে ‘মাতৃসান্নিধ্যে
ছাপবার কালে তিনি অদ্বৈত
আশ্রমে মায়ের ফটোর জন্য
এলেন।
তিনি তিনটি ফটো select
করলেন।
প্রথম ছবি—উদ্বোধনে মা ধ্যানরতা।
ঐ ছবির বিষয়ে বরদা মহারাজ
বলেন,
“একদিন
মা উদ্বোধনে ঠাকুরঘরে ধ্যান
করছেন।
তখন গণেন মহারাজ তাঁর
tripod
বসিয়ে
ক্যামেরা দিয়ে ঐ ছবি তােলেন।
Tripod-এর
শব্দতে মা চোখ খােলেন,
তখন
গণেন মহারাজ বলেন,
“মা, আপনার একটা ছবি নিচ্ছি।' ঐকালে মায়ের চোখ খােলা অবস্থার আর একটা ছবি নেন।”
দ্বিতীয়
ছবি—পিছনে ধানের বস্তা,
মায়ের
পা ঝুলিয়ে বসা।
এই ছবি প্রসঙ্গে
বরদা মহারাজ বলেছিলেন,
“মা
অন্নপূর্ণা।”
এতদিন লােকের
ধারণা ছিল ছবিটি মায়ের পুরানাে
বাড়িতে তােলা।
১৯৮৬ সালে
জয়রামবাটীর প্রভাত মহারাজ
আমাকে বলেন যে,
ওটি
সতীশ বিশ্বাসের বাড়িতে তােলা।
তিনি বলেন,
“রামময়
মহারাজ তাঁকে ও অব্জজানন্দজীকে
বলেছিলেন যে,
তিনি
ঐকালে উপস্থিত ছিলেন।
যাহােক,
স্বামী
সারদেশানন্দজীর স্মৃতিকথাতে
আছে—মা বাঁকুকে দেখবার জন্য
সতীশ বিশ্বাসের বাড়ি যান।
তাঁর স্ত্রী মায়ের জন্য
মাটির বারান্দায় একটা গালিচা
বিছিয়ে দিলেন। তাঁর বর্ণনা
ঃ “পূর্বমখী।
হইয়া...
বারান্দার
কিনারায় বসিয়াছেন,
নিচে
পা ঝুলিতেছে।
- কোলের উপর হাত দু-খানি,
- পরিধানে লাল সরুপাড় শুভ্রবস্ত্র,
- ঈষৎ ঘােমটা টানা,
- প্রসন্ন মুখমণ্ডল,
- ঈষৎ কুঞ্চিত কেশরাশি বক্ষের দক্ষিণ পাশ হইয়া নিচে ঝুলিতেছে।
- মা বসিয়াছেন এমনই ভাবে,
- দেখিলে মনে হয় যেন মা-লক্ষ্মী স্বয়ং ভাগ্যবান গৃহস্থের দরজায় উপবিষ্টা,
- পাশেই ধান্যপূর্ণ মরাই (ভাণ্ডার) শােভা বিস্তার করিয়া তাঁহার শুভাগমন সূচনা করিতেছে।”
(শ্রীশ্রীমায়ের
স্মৃতিকথা,
পৃঃ
১০৫)।
বরদা
মহারাজ তৃতীয় ছবিটির বিষয়
বলেন,
“গণেন
মহারাজ মায়ের বসা একটা ছবি
নেন,
তাতে
তাঁর ডান হাঁটু লম্বা এবং বাঁ
হাঁটু ছােট দেখায়।
শরৎ মহারাজ
ঐ ছবি দেখে গণেনকে বলেন,
“তুই
মায়ের এ কী ছবি তুলেছিস?
তুই
আমার জন্য মায়ের মুখের একটা
ছবি তুলে দে।'
এটাই
সেই ছবি।”
ঐ ছবি প্রসঙ্গে বরদা
মহারাজ বলেছিলেন,
“দেখ,
মা
ছিলেন কৌশাম্বী।”
তারপর
কৌশাম্বী দেবীর ব্যাখ্যাকালে
বলেন,
“যে
বিবাহিতা স্ত্রীর unbroken
chastity থাকে
শাস্ত্রে তাঁকেই কৌশাম্বী
বলে।
চণ্ডীতে কৌশাম্বীর উল্লেখ
আছে।”
Sri
Ramakrishna
|
“মহারাজ,
আপনি
মায়ের সঙ্গে প্রায় এগারাে
বছর ছিলেন।
আপনি বলুন তাে,
- আমাদের বাড়িতে মা,
- বােন,
- মাসি,
- পিসি,
- মামি
প্রভৃতি যে নারীরা আছেন তাঁদের
সঙ্গে শ্রীশ্রীমায়ের পার্থক্য
কোথায়?
”
বরদা
মহারাজ একটু চুপ করে থেকে
বললেন,
“তুমি
কোনাে মানুষ দেখেছ যে একেবারে
বাসনাশূন্য?
শ্রীমা
ছিলেন সম্পূর্ণ বাসনাহীন।
দেখ,
মানুষ
মাত্রেই কোনাে-না-কোনাে
বাসনার অধীন।
একমাত্র ভগবানই
বাসনামুক্ত।
শ্রীমা ছিলেন
স্বয়ং দেবী ভগবতী।”
অন্যান্য
নারীর সঙ্গে শ্রীমায়েরপার্থক্য প্রসঙ্গে স্বামী
বিশুদ্ধানন্দজীর একটা কথা
মনে পড়ে।
তাঁকে বহুবার দেখেছি,
প্রণাম
করেছি,
কিন্তু
কথা বলার সুযােগ পাইনি।
তিনি
বলতেন,
“মাকে
আমি নিজে একটা নাম দিয়েছি
‘গণ্ডিভাঙা মা'।
আর যে সব মা দেখি তাদের একটি
গণ্ডি আছে।
তাদের স্নেহ কেবল
নিজের সন্তানেই আবদ্ধ।
কিন্তু
এই যে মা-ইনি
জগতের মা।”
স্বামী
দেবানন্দজী পঞ্চাশের শেষ
দশকে বলরাম মন্দির দেখাশােনা
করতেন এবং প্রতি শনিবার বক্তৃতার
ব্যবস্থা করতেন।
বিখ্যাত
সাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার
সেনগুপ্ত ধারাবাহিকভাবে
প্রতি শনিবার সেখানে পরমাপ্রকৃতি
সারদামণির ওপর বক্তৃতা দিতেন।
অচিন্ত্যবাবু পরমাপ্রকৃতি
শ্ৰীশ্ৰীসারদামণি নামে একটি
জীবনী-গ্রন্থ
লেখেন।
ঐ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ
করেন ঃ
“বরদা নাম্নী এক
অল্পবয়স্কা বিধবা মায়ের
সঙ্গে জয়রামবাটী গিয়েছিলেন।
পরে একদিন অচিন্ত্যবাবুর
বক্তৃতার পর বরদা মহারাজ তাঁর
চাদরে ঘােমটা দিয়ে মুখ ঢেকে
অচিন্ত্যবাবুকে বলেন,
“অচিন্ত্যবাবু, আমিই
সেই অল্পবয়স্কা বিধবা বরদা।”
অচিন্ত্যবাবু অপ্রস্তুত হয়ে
ক্ষমা চেয়েছিলেন।
বরদা
মহারাজ শ্রীশ্রীমায়ের যে
কী গভীর স্নেহ-ভালবাসা
পেয়েছেন,
তা
ভাষায় বর্ণনা করবার নয়।
তা
মাপার ক্ষমতা আমার নেই।
ভালবাসা
প্রাণের জিনিস,
তা
ভাষায় বা মুখে ব্যক্ত করা
যায় না।
কেবল অনুভব করা যেতে
পারে।
মায়ের ভালবাসা পাওয়ার
সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে,
তাঁরা
অন্তরে অন্তরে তা অনুভব করেছেন।
পিতামাতার ভালবাসা তার কাছে
ম্লান হয়ে যায়।
No comments