প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী সর্বজ্ঞানন্দ (১৯০২-১৯৮৮)
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী সর্বজ্ঞানন্দ (১৯০২-১৯৮৮)
Ma
Bhabatarini (Kali)
|
স্বামী
শিবানন্দের স্মৃতি
১৯২১
সালে মাদ্রাজ মঠে আমি মহাপুরুষ
মহারাজকে দর্শন করি রাজা
মহারাজের সঙ্গে। কীর্তনের
সময় তিনি তবলা বাজাতেন। তিনি
খুব রাশভারী ছিলেন,
তাই
সবাই তাঁর কাছে যেতে সাহস পেত
না। একবার স্বামী শ্রীনিবাসানন্দ
মহাপুরুষজীর একটি ছবি তুলতে
গেলে তিনি নিষেধ করেন। পরে
শ্রীনিবাসানন্দ যখনই ছবি
নিতে চেষ্টা করতেন মহাপুরুষজী
মাথা নাড়তেন।
মহাপুরুষজী
বেলুড়ে মঠবাড়ির দোতলায়
ঠাকুরঘরের পাশের ঘরে থাকতেন।
আমি একদিন ভয়ে ভয়ে তাঁর ঘরে
দেখা করতে গেলাম। দরজার ফ্রেম
ধরে আমি ঘরের মধ্যে একটু উঁকি
দিয়ে দেখলাম,
তিনি
একটা সাধারণ
ক্যানভাসের
চেয়ারে বসে আছেন। তিনি বুঝতে
পেরেছেন,
আমি
তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছি।
হঠাৎ তিনি মুখ দিয়ে একটা শব্দ
করে দু-হাতে
তালি দিলেন। আমি
ভয়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত
নিচে নেমে গেলাম। পিছনে তাকিয়ে
দেখি,
মহাপুরুষজী
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর
মতাে হাসছেন। এ ঘটনায় তাঁর
প্রতি আমার ভয় আরাে বেড়ে
গেল।
Sri
Sarada Devi, Swami Vivekananda, Swami Shivananda
|
আমি
এরপর মাদ্রাজ মঠে ব্রহ্মচারী
হয়ে যােগদান করি এবং ১৯২৬
সালে আবার মহাপুরুষজীকে দর্শন
করি। আমি ও রুদ্রানন্দ ছাড়া
সব সাধু তাঁকে অভ্যর্থনা করতে
মাদ্রাজ স্টেশনে যান। তাঁর
প্রতি সেই পুরানাে ভয় আমার
তখনাে ছিল। আমি যেখানে
দাঁড়িয়েছিলাম মহাপুরুষজী
সেখানে মােটরগাড়ি থেকে নামলেন
এবং মা যেমন তাঁর সন্তানের
দিকে তাকান সেভাবে তিনি আমার
দিকে তাকালেন। আমার মনে হলাে,
তিনি
সম্পূর্ণভাবে পালটে গিয়েছেন
এবং আমার সব ভয় চলে গেল।
প্রত্যেকদিন
জপধ্যানের পর আমরা তাঁর ঘরে
যেতাম তাঁকে প্রণাম করতে।
কখনাে তিনি কথা বলতেন,
কখনাে
বলতেন ‘অল রাইট’,
আবার
কখনাে চুপ করে বসে থাকতেন।
একদিন আমি যখন প্রণাম করলাম,
তিনি
আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি বললাম। তার পরের দু-দিনও
তিনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন
এবং বললেন,
“দেখ,
আমি
তােমার নামটা ভুলে যাচ্ছি।
আমি তােমাকে একটা নাম দেব?”
আমি
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অন্যান্য সাধু আমাকে ইঙ্গিত
করে ‘হ্যাঁ’ বলতে বললেন।
কিন্তু আমি এত লাজুক যে কিছুই
বলতে পারলাম না। তিনি তখন
বললেন,
“তােমার
নাম ‘ভজহরি'।
এর মানে কী জান?
এর
অর্থ হচ্ছে—ভগবানের পূজা
করাে।” আমি নির্বাক হয়ে
দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ তিনি
ভজহরি হরি ভজ,
ভজহরি
হরি ভজ’ বলে নাচতে শুরু করলেন।
সবাই হাসতে লাগল। তিনি বললেন,
“এই
হলাে তােমার নাম।” সেই থেকে
আমার নাম হলাে ‘ভজহরি।
Sri
Sarada Devi
|
একদিন
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম,
“মহারাজ,
আপনি
বলেছিলেন। যে,
ঠাকুর
আপনার জিভে কী লিখে দেন,
তাতে
আপনি কুণ্ডলিনীর বিভিন্ন
চক্রে চেতনা অনুভব করেছিলেন।
আপনি কি এখনাে তা অনুভব করেন?”
একথা
শুনে সকলে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে
বলতে চাইছিলেন যে,
এরকম
ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা আমার
উচিত হয়নি। কিন্তু মহাপুরুষজী
বললেন,
“হ্যাঁ,
আমি
এখনাে তা অনুভব করি।”
আরেক
দিন মহাপুরুষজী বললেন,
“ভজহরি,
তুমি
নট্টরামপল্লি গিয়ে স্বামী(
–র
)কর্মভার
গ্রহণ করাে যাতে সে আমার কাছে
কয়েক দিন থাকতে পারে।” আমি
বললাম,
“মহারাজ,
আমি
যেতে চাই না। আপনি মাদ্রাজে
খুব কমই আসেন,
আমি
গেলে আপনার পুণ্যসঙ্গ হারাব।
আপনি আর কাউকে। পাঠান।” মহারাজ
হাসলেন। আমি যখন ঘর থেকে বাইরে
এলাম তখন। অন্যান্য সাধু আমাকে
নিজের গুরু ও সঙ্গুরুর প্রতি
অসৌজন্যমূলক ব্যবহারের জন্য
বকুনি দিলেন। আমি আবার মহাপুরুষজীর
ঘরে গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা
করে বললাম,
“মহারাজ,
আমি
নট্টরামপল্লি যাব।” তিনি
বললেন,
“না,
তুমি
আমার কাছে থাকো।” আমার পরিবর্তে
তিনি স্বামী চিভবানন্দকে
পাঠালেন।
Swami
Shivananda
|
আরেক
দিন আমি বাগানে ফুল তুলছি।
মহাপুরুষজী জানালা দিয়ে
আমাকে ডেকে কয়েকটা ফুল চাইলেন।
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম,
কারণ
স্বামী অনন্তানন্দ আমাকে
বলেছিলেন—ঠাকুরের পূজার ফুল
অগ্রে কাউকে দেবে না। তিনি
আমাকে আরাে শিখিয়েছিলেন যে,
পূজার
ফুল যেন শরীর,
কাপড়
বা চুল স্পর্শ না করে এবং
ঠাকুরঘরে নিয়ে যাওয়ার আগে।
শরীর,
কাপড়
বা চুল স্পর্শ না করে এবং
ঠাকুরঘরে নিয়ে যাওয়ার আগে
যেন ধােয়া হয়। আমার দ্বিধা
দেখে মহাপুরুজী বললেন,
“ভজহরি,
আমি
ঠাকুরঘরে যাচ্ছি। আমাকে
কয়েকটা ফুল দাও। আমি ঠাকুরকে
অর্ঘ্য দেব।” আমি তখনি তাঁকে
কয়েকটা ফুল দিলাম।
মহাপুরুষজীর
কখনাে কখনাে পিঠে ব্যথা হতাে।
তিনি রােজ হাঁটতেন। যন্ত্রণা
থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য
তিনি একদিন রাঘবনকে একটু
ম্যাসাজ করতে বললেন। কিন্তু
রাঘবনের ম্যাসাজ পছন্দ না
হওয়ায় তিনি আমাকে ম্যাসাজ
করতে বললেন। আমার মহাসৌভাগ্য
যে আমি আমার গুরুকে কয়েক দিন
ব্যক্তিগত সেবা করবার সুযােগ
পেয়েছিলাম।
১৯২৭
সালে স্বামী সারদানন্দের
মহাসমাধির পর আমি মহাপুরুষজীকে
বেলুড় মঠ দর্শনের অনুমতি
চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি
উত্তরে লেখেন । “তুমি অধ্যক্ষ
স্বামী যতীশ্বরানন্দের অনুমতি
নিয়ে আসবে।” আমি তাঁর কথামতাে
অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে বেলুড়
মঠে গেলাম। মহারাজ আমাদের
খুব যত্ন নিতেন। তখন বেলুড়
মঠে দক্ষিণ ভারতীয় সাধু খুব
কম ছিল;
তবু
তিনি আমাদের জন্য রস,
সাম্বার,
টকদই
প্রভৃতির ব্যবস্থা করতেন।
Swami
Vivekananda
|
ঐ
বছর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে
কয়েক জন ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসের
জন্য মঠে আসেন। মহাপুরুষজী
আমাকে জিজ্ঞাসা করেন,
“ভজহরি,
তুমি
সন্ন্যাস নেবে?”
আমি
বললাম,
“না,
মহারাজ,
এ
বছর নয়। নিয়মানুযায়ী আমার
সন্ন্যাস দেড় বছর পরে হবে।”
যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম,
অপূর্বানন্দজী
আমাকে সন্ন্যাস নিতে না চাওয়ার
জন্য বকলেন। তাঁকে বললাম,
“এখন
সন্ন্যাস নিলে বহুদিন আমার
বেলুড় মঠে আসা হবে না।”
১৯৩০
সালে আমি আবার বেলুড় মঠে এসে
মহাপুরুষজীকে স্বামীজীর
জন্মদিনে সন্ন্যাসের জন্য
প্রার্থনা জানালাম। তিনি
বললেন,
“ও,
তুমি
স্বামীজীর জন্মদিনে সন্ন্যাস
চাও। হ্যাঁ,
স্বামীজীর
জন্মদিনও ঠাকুরের জন্মদিনের
মতাে পবিত্র। তুমি শুদ্ধানন্দের
কাছে গিয়ে তােমার নাম তালিকায়
যুক্ত করে। নাও।” আমি স্বামী
শুদ্ধানন্দের কাছে গিয়ে
বললে,
তিনি
বললেন,
“তুমি
স্বামীজীর জন্মদিনে সন্ন্যাস
চাইলে কেন?
সাধারণত
ঠাকুরের জন্মদিনেই সন্ন্যাসদীক্ষা
হয়।” আমি চুপ করে রইলাম। যাই
হােক,
স্বামীজীর
জন্মদিনেই আমার সন্ন্যাস
হলাে।
সন্ন্যাসের
পর প্রয়াগে কুম্ভমেলায়
যােগ দেওয়ার জন্য আমি মহাপুরুষজীর
অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে
জিজ্ঞাসা করলেন,
“তােমার
কাছে যাওয়ার টাকা আছে?”
আমি
বললাম,
“আমার
কাছে ১২ টাকা আছে।” তখন কলকাতা
থেকে এলাহাবাদের ট্রেনভাড়া
ছিল ৪ টাকা। মহারাজের অনুমতি
নিয়ে আমি প্রয়াগে কুম্ভমেলায়
যােগ দিতে গিয়েছিলাম।
যদিও
বহু বছর পেরিয়ে গিয়েছে,
মহাপুরুষ
মহারাজ এখনাে আমার স্মৃতিতে
বিদ্যমান। তিনি একজন মহান
প্রেমিক পুরুষ ছিলেন।
No comments