প্রাচীন সাধুদের কথা_স্বামী স্বপ্ৰকাশানন্দ(১৮৯০-১৯৮৩) - Spirituality Religion

Header Ads

প্রাচীন সাধুদের কথা_স্বামী স্বপ্ৰকাশানন্দ(১৮৯০-১৯৮৩)

প্রাচীন সাধুদের কথা_স্বামী স্বপ্ৰকাশানন্দ(১৮৯০-১৯৮৩)

Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna

ভক্তেরা মহাপুরুষজীর জন্য নানাবিধ জিনিস নিয়ে আসত। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “ভক্তদের সব জিনিস প্রথমে খানিকটা তুলে নিয়ে ঠাকুরকে দেবে। এ-ব্যাপারে আমাকে আর কোনাে জিজ্ঞাসা করতে হবে না।”
একদিন আরতির পর আমি মহাপুরুষজীকে প্রণাম করতে গিয়েছি। প্রণাম করে চলে আসছি, তখন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি স্বামীজীর ঘরে প্রণাম করেছ?” আমি বললাম, “না, ওখানে প্রণাম করিনি। এখন গিয়ে করব।” তিনি বললেন, “আগে ওখানে প্রণাম করবে, পরে এখানে। সাক্ষাৎ শিব স্বামীজী ওখানে রয়েছেন।” মহাপুরুষজীর এই কথাটা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে।
একদিন ব্ৰহ্মকুণ্ডে স্নান করতে গিয়েছি। ফিরে এলে হরি মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, “সুরেন, কোথায় গিয়েছিলে?” আমি বললাম, “ব্ৰহ্মকুণ্ডে স্নান করতে গিয়েছিলাম।” “কেন? অন্য জায়গাতেও তাে স্নান করতে পারতে।” “না মহারাজ, ব্ৰহ্মকুণ্ড খুব পবিত্র স্থান। বহু লােকে সেখানে স্নান করে যাতে ধর্মভাব জাগে।” “তােমার কি ধর্মভাব জেগেছে?” “না, মহারাজ। তবে স্নানের সময় গঙ্গামায়ীকে প্রণাম করেছি ও পবিত্রতার জন্য প্রার্থনা




Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna
করেছি। আর শিবের কয়েকটা স্তব আবৃত্তি করেছি।” তখন হরি মহারাজ বললেন, “দেখ, তুমি যে পুণ্য ব্ৰহ্মকুণ্ডে স্নান করেছ তখন তােমার তত্ত্বচিন্তা মনে রাখতে হবে। কেন স্নান করছি? পবিত্র হওয়ার জন্য। পবিত্র হৃদয়ে আত্মতত্ত্ব ফুটে উঠে। অন্যান্য দেবদেবীও দর্শন করেছ, কিন্তু উদ্দেশ্য হলাে আত্মজ্ঞান লাভ এবং ভক্তিভাবকে প্রবল করে রাখা। লােকে তীর্থে যায় ঐ পুণ্যস্মৃতি হৃদয়ে ধরে রাখবার জন্য।” হরি মহারাজের এই কথা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। তারপর থেকে যখনই ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করতে গিয়েছি হরি মহারাজের কথা মনে হতাে।
কখনাে কখনাে বিকালে কনখল থেকে হরি মহারাজের সঙ্গে ব্রহ্মকুণ্ডে বেড়াতে যেতাম। তিনি ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি নিচে নেমে গঙ্গা স্পর্শ করে হাতে একটু জল এনে মহারাজকে দিতাম। তিনি নিজের মাথায় ছিটাতেন। একদিন বলেন, “দেখ, ‘গঙ্গে চ যমুনা চৈব’ মুখে বললেই হবে না। আন্তরিকভাবে পবিত্রস্বরূপিণী পবিত্ৰকারিণী মা-গঙ্গার কাছে পবিত্রতা প্রার্থনা করবে।”



Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna

সাধনভজনের আসল রহস্য রয়েছে অভ্যাসের ওপর। সকালে, স্নানের পর, সন্ধ্যায় ও রাতে নিত্যনিয়মিত ধ্যানজপ করতে করতে অন্তর্জগৎ খুলে যায় ও আনন্দ আসে। ঠাকুরের সন্তানদের সঙ্গ করেছি, তাঁদের অনেক উপদেশ শুনেছি, কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে অভ্যাস। উপদেশ জীবনে পরিণত করতে হবে।
দেখ, আমরা সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হয়েছি। তারপর মহাবাক্যাদি সন্ন্যাসমন্ত্র যথাসম্ভব গ্রহণ করে রেখে দিয়েছি। হরি মহারাজ ঐসব মন্ত্র শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের ওপর জোর দিতেন। দেখ, -বিষয়ে একটা শ্লোক আছে ? ‘নিত্যং কর্ম পরিত্যজ্য বেদান্তঃ শ্রবণং বিনা। বর্তমানস্তু সন্ন্যাসী পতত্যেব নাসংশয়।' নিত্যকর্ম বলতে বােঝায় গুরুর উপদেশমতাে জপধ্যান করা; তারপর বেদান্তাদি শাস্ত্রের শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন। এসব অভ্যাসই সাধুজীবনকে পতন থেকে রক্ষা করে।

তারপর আমার একটা সন্দেহ এল। অনেকেরই এই সন্দেহ আসে। আমি দীক্ষার সময় ইষ্টমন্ত্র পেয়েছি আর এখন সন্ন্যাসের সময় প্রেষমন্ত্র ও মহাবাক্য পেয়েছি। ইষ্টমন্ত্র দ্বৈতমূলক আর মহাবাক্য (অহং ব্রহ্মাস্মি) অদ্বৈতমূলক।
Sri Ramakrishna

Sri Ramakrishna



এখন কোটা অভ্যাস করব? যেহেতু আমরা সন্ন্যাসী, এই প্রেষমন্ত্র ও মহাবাক্যই আমাদের অভ্যাস করা উচিত। এ-বিষয়ে হরি মহারাজের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বললেন, “দেখ, এসব মনের স্বভাব। আমরা যে ইষ্টমন্ত্র গ্রহণ করেছি তা জীবনের উন্নতির জন্য-ইষ্টকে দর্শন ও উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ইষ্টমন্ত্র জপ করে তােমার জীবনে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু উপলব্ধি হয়নি। এখন সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হলে চাই আন্তরিকতা এবং তীব্র বিবেক ও বৈরাগ্য। মন যখন উচ্চস্তরে থাকে তখন অদ্বৈত তত্ত্ব—মহাবাক্য বা স্বরূপের ধ্যান অভ্যাস করাে। আর যখন মন নিম্নস্তরে থাকে অর্থাৎ দ্বৈত জগতে তখন ইষ্টমন্ত্র ও ইষ্টের ধ্যান অভ্যাস করবে।”
দেখ, দ্বৈত ও অদ্বৈতের কোটা ঠিক—এ সন্দেহ কেটে যায় উপলব্ধি হলে। তারপর মনের বৃত্তিটা একটার ওপর দৃঢ়ভাবে থাকে। সন্ন্যাসীর বেদান্তবিচার নিয়েই থাকা উচিত। উত্তরাখণ্ডের সাধুদের দেখতাম দ্বৈতের প্রতি একটা অবজ্ঞার ভাব; কিন্তু ঠাকুরের সন্তানদের মধ্যে সেটা দেখিনি।
শঙ্করাচার্য বলেছেন : ভাবাহদ্বৈতং সদা কুর্যাৎ ক্রিয়াহদ্বৈতং ন কৰ্হিচিৎ। অদ্বৈতং ত্রিষু লােকেষু নাদ্বৈতং গুরুণা সহ৷৷—সর্বদা অদ্বৈতভাব অবলম্বন। করবে; কখনও ক্রিয়াতে অদ্বৈতভাব অবলম্বন করবে না। অদ্বৈতং ত্ৰিষু লােকে নাদ্বৈতং গুরুণা সহ।।—সর্বদা অদ্বৈতভাব অবলম্বন করবে; কখনও ক্রিয়াতে অদ্বৈতভাব অবলম্বন করবে না। ক্রিয়াতে অদ্বৈতবুদ্ধি হলে ক্রিয়ার অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তিন লােকে অদ্বৈতবুদ্ধি রাখবে, কিন্তু গুরুর সঙ্গে অদ্বৈত-ভাব করবে না। গুরু ও শিষ্য এক হলে কখনও জ্ঞানলাভ হবে না।

রাজা মহারাজ আমাদের দ্বৈতাত্মক উপদেশই দিতেন। ইষ্টের প্রতি অনুরাগ, প্রেমভক্তি ক্রমে মনকে অদ্বৈততত্ত্বে নিয়ে যাবে। ইষ্টমন্ত্র জপের সঙ্গে তিনি ইষ্টের রূপ ও গুণ চিন্তা করতে বলতেন। সাধনার উন্নতি নিত্যনিয়মিত অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে।
প্রশ্ন ওঠে ধর্মজীবনে রুচি বা আস্বাদ কী করে পাওয়া যায়? সেটা নির্ভর করে অনুভূতির ওপর, আর অনুভূতি আসে ব্যাকুলতা ও ভাবভক্তির ভেতর দিয়ে। বিবেক ও বৈরাগ্য চাই। দেখ, শাস্ত্র বলছেন—অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরােধঃ। ইষ্টের নাম-রূপ ধরে সাধনভজন করতে করতে আস্বাদ আসে। ভেতরে আনন্দ হয়। মন বসুক আর না বসুক নিত্য অভ্যাস করে যাও।




No comments

Powered by Blogger.