টিকি রাখা, গেরুয়া পরা উদ্দেশ্য নয়; এগুলো উপায় মাত্র - Spirituality Religion

Header Ads

টিকি রাখা, গেরুয়া পরা উদ্দেশ্য নয়; এগুলো উপায় মাত্র


স্বামী সুহিতানন্দের ‘সারগাছির স্মৃতি’ থেকে

==========================
 
সারগাছির স্মৃতি
সারগাছির স্মৃতি


স্বামী সুহিতানন্দের ‘সারগাছির স্মৃতি’ থেকে


সেবক: এখন সঙ্ঘে যোগদান করতে এত নিয়ম, অথচ আগেকার মহারাজগণ তো সেরকম করতেন না?
মহারাজ: দেখ, তখন মহারাজরা অনেকেই সন্ন্যাসী বানিয়ে দিতেন। তাঁরা অধিকারী পুরুষ ছিলেন।
কেউ কেউ ভাবে, যারা ধ্যান করে না তাদের হবে না।
কেউ হয়তো ধ্যান, পাঠ করে। 
কিন্তু দেখা গেল, যে ‘কাজ কাজ’ করে বেড়াত, মরার সময় সে ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলে চলে গেল। 
অর্থাৎ সে কাজে থাকত, সে জানত যে, আমি ধ্যান পারি না; কিন্তু তার দৃঢ় আস্থা ছিল যে, আমি ঠাকুরেরই কাজ করছি।
 কথামৃতে পড়েছ তো—ঠাকুর মন দেখেন।

সেবক: রামকৃষ্ণ মিশনের কাজে এখন যে এত রজোগুণ এসেছে—এতে কি কোনো ক্ষতি হবে?
মহারাজ: এতে সংসারীদের উপকারই হয়; যতই building হবে, যত রাজসিক কাজ হবে, ততই এখন দেশের মঙ্গল।
 তবে সন্ন্যাসীর জীবন আলাদা, 
কিছুদিন কাজ করে একেবারে সরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়—
  1. কতখানি আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি? 
  2. ধ্যান করা মানে কী? 
  3. কেবল দেখা—মন কীসে কীসে নাচে? 
  4. কেন মন শ্রীরামকৃষ্ণকে চায় না? 
  5. কোন্‌ জিনিসটা সে চায়? 
  6. বুকের ভেতর না গিয়ে কেন সে বাইরের রূপ-রস-শব্দ- গন্ধ-স্পর্শ চায়? 
যখনি দেখবে মন স্থির নয়, তখনি বুঝবে মন উত্তেজিত হয়েছে—হয় কামে, নয় ক্রোধে, নয় লোভে, নয় মাৎসর্যে।
 মনকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করার অভ্যাস হলো ধ্যান। 
অর্থাৎ সারাদিনের কাজের মধ্যে অন্তত কিছু সময় এমন একটা জিনিস চিন্তা করব, যা প্রশান্ত অর্থাৎ সেটা আমার উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেবে।
আসল ব্যাপার হলো স্বাভাবিক হওয়া।
 হাঁটা, চলা, খাওয়া—সব ব্যাপারে স্বস্থ থাকা। 
দেখ না, কেউ বেশি ঝাল খায়, কেউ থপ থপ করে হাঁটে; নিশ্চয়ই জানতে কিছু-না-কিছু তার কারণ আছে।
যারা রজোগুণী, তারা নিজেকে প্রকাশ করতে চায় মানযশের জন্য। 
দেখ, আমি statement of fact বলি, তোমাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিই। 
কিন্তু কাউকে ঘৃণা করি না—কাছে ডাকি, বসাই, সুখ-দুঃখের কথা বলি।
যে যা প্রশংসা করবে—সাবধানে নেবে। 
কারণ, সংসারে তোমার কিছু গ্রহণীয় নেই, সবই পরিত্যাজ্য।
 কেউ যদি কখনো তোমাকে মহাপুরুষ বলে, সাবধান হবে।
যদি তোমার কাজের নেশা থাকে, তাহলে হিমালয়ে গিয়েও নিস্তার নেই, সেখানে আবার ঘর-বাড়ি করে হাঙ্গামা বাধাবে। 
কাজের নেশা এমনই।

সারগাছির স্মৃতি
সারগাছির স্মৃতি

স্বামী সুহিতানন্দের ‘সারগাছির স্মৃতি’ থেকে

সেবক: মহারাজ, আপনাদের সময়ের সঙ্গে বর্তমান কালের কী তফাত দেখছেন?
মহারাজ: দেখ, তোমাদের অনেক সুবিধা। 
দেশ স্বাধীন হয়েছে, লেখাপড়ায় উন্নতি করার ইচ্ছা এসেছে চারিদিকে। অনুকূল পরিবেশ।
 আমাকে লেখাপড়া শিখতে কত বেগ পেতে হয়েছে।

সেবক: মহারাজ, আমাদের কি জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করা উচিত?
মহারাজ: দেখ, একদিন পরে আমাদের কী হবে বলতে পারি না। আবার এই বুদ্ধি নিয়েই আমরা বড়াই করি! জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতিতে সন্ন্যাসীর নিষেধ আছে।
 কারণ, ওসবের মধ্যে কণামাত্র সত্য থাকে।
 এক গল্প আছে—যোগী বলল, রাজার মৃত্যু হবে অমুক দিন।
 মন্ত্রী যোগীকে পালটা প্রশ্ন করে জানল, যোগীর কুড়ি বছর পর মৃত্যুদিন।
 কিন্তু মন্ত্রী তার গলা কেটে জানিয়ে দিল গণনা ভুল।

সেবক: মন কী করে গুরু হয়?
মহারাজ: যদি তোমার ইষ্টে অধিক টান হয়, তাহলে তোমার মন ইষ্টপ্রীতি ছাড়া অন্য কিছুতে যেতে চাইবে না।
 অর্থাৎ মন ভাল জিনিসই নেবে।
 তখনি মন গুরু হয়ে যায়।
 তোমাদের বিশ্বাস থাকা চাই—
আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে আশ্রয় করেছি, আমার আবার ভাবনা কী?
 ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব হচ্ছে, ঈশ্বর সব সেজেছেন বলে নিজের কর্তব্য এড়িয়ে গেলে চলবে না। 
যতক্ষণ দেহের মধ্যে আছি ততক্ষণ ও কথা বলার জো নেই।

প্রশ্ন: দেহাতীত অবস্থা কীরকম?
মহারাজ: গাড়িতে চড়া ও নামার মতো। 
যতক্ষণ গাড়িতে আছ ততক্ষণ দেহের সুখ-দুঃখ বোধ করছ।
 নেমে গেলেই আত্মানন্দ—স্বরাট। 
ঠাকুর, মা প্রায়ই সেই অবস্থায় চলে যেতেন, আর আনন্দবোধ করতেন—পরম আনন্দ! মা সারাদিন কুটনো কোটা, বাটনা বাটা করতেন আর মাঝে মাঝে বলতেন, ‘আমি এ কী করছি!’ তবে তাঁরা সেখানেও যেতে পারতেন, এখানেও আসতে পারতেন।
 তাঁদের শুদ্ধসত্ত্ব দেহ কামক্রোধবিযুক্ত।
 আমরা একবার গেলে আর কী এই নরকে আসি—সে আনন্দের হাটবাজার ছেড়ে?
সারগাছির স্মৃতি
সারগাছির স্মৃতি

স্বামী সুহিতানন্দের ‘সারগাছির স্মৃতি’ থেকে

সেবক: গীতায় আছে ‘সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহস্তি ন প্রিয়ঃ।’ আবার আছে, ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানা-সুরীষ্বেব যোনিষু।’ পরস্পরবিরুদ্ধ এই দুই ভাবের মিল কীভাবে করব?
মহারাজ: এগুলো আপেক্ষিক সত্য।
 একস্তরে মনে হয়—ক্ষিপাম্যহম্‌; আবার পরের স্তরে দেখা যায়—কেউ কাউকেও ক্ষেপণ করে না।
দুপুরবেলা মহারাজকে তুলতে গিয়ে সেবক তাঁর জামাটা ছিঁড়ে ফেলল। দুঃখিত মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
মহারাজ: কী হয়েছে তাতে?
 সন্ন্যাসীর জিনিস ছেঁড়া থাকবে তাতে কী?
 ছেঁড়া কাঁথা মুড়া মাথা।
 সেদিন একটা ছোট মেয়ে এসেছে মায়ের সঙ্গে। 
বাচ্চাটাকে আমি বললাম, ‘তুমি এখানে থাকবি?’
 সে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা যদি থাকে।’
 ঈশ্বরের প্রতি এরকম টান চাই।
 খুব ভাল করে শুনে রাখো—আধ্যাত্মিক জীবন হলো সবটাই মনের ব্যাপার। 
অন্তর্জীবন লোক-দেখানো কোনো ব্যাপার নয়—টিকি রাখা, গেরুয়া পরা উদ্দেশ্য নয়; এগুলো উপায় মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.