নাগ মহাশয় _ঠাকুরের সম্বন্ধে কিছু বলুন
নাগ মহাশয় ঠাকুরের সম্বন্ধে কিছু বলুন!
২৫শে অগস্ট সাধু নাগ মহাশয় [দুর্গাচরণ নাগ] এর শুভ জন্মতিথি । নারায়ণগঞ্জের নাগপাড়ায় ।
কেমন ছিল স্বামীজির সাথে এই মহাত্মার সম্পর্ক?
এই ঘটনা থেকে আসুন জেনে নিই –
একদিন ঠাকুর বল্লেন, পরমহংসেরা কখন কখন উন্মাদের মত ব্যবহার করেন
-----------------------------------------------
স্থান—বেলুড়মঠ
কাল—১৮৯৯ খৃঃ প্রারম্ভ
-------------------------------------
নাগ মহাশয়
শিষ্য অদ্য নাগ-মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া মঠে আসিয়াছে।
স্বামীজী। (নাগ-মহাশয়কে প্রণাম করিয়া) ভাল আছেন তো?
নাগ-মহাশয়। আপনাকে দর্শন করতে এলাম।
জয় শঙ্কর! জয় শঙ্কর!
সাক্ষাৎ শিব-দর্শন হল।
কথাগুলি বলিয়া নাগ-মহাশয় করজোড়ে দন্ডায়মান রহিলেন।
স্বামীজী। শরীর কেমন আছে?
নাগ-মহাশয়। ছাই হাড়মাসের কথা কি জিজ্ঞাসা করছেন?
আপনার দর্শনে আজ ধন্য হলাম, ধন্য হলাম।
ঐরূপ বলিয়া নাগ-মহাশয় স্বামীজীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিলেন।
স্বামীজী। (নাগ-মহাশয়কে তুলিয়া) ও কি করছেন?
নাগ-মহাশয়। আমি দিব্য চক্ষে দেখছি, আজ সাক্ষাৎ শিবের দর্শন পেলাম।
জয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী। (শিষ্যকে লক্ষ্যে করিয়া) দেখছিস, ঠিক ভক্তিতে মানুষ কেমন হয়!
নাগ-মহাশয় তন্ময় হয়ে গেছেন, দেহবুদ্ধি একেবারে গেছে! এমনটি আর দেখা যায় না ।
(স্বামী প্রেমানন্দকে লক্ষ্য করিয়া) নাগ- মহাশয়ের জন্য প্রসাদ নিয়ে আয়।
নাগ-মহাশয়। প্রসাদ! প্রসাদ! (স্বামীজীর প্রতি করজোড়ে) আপনার দর্শনে আজ আমার ভবক্ষুধা দূর হয়ে গেছে।
মঠে ব্রহ্মচারী-ও সন্ন্যাসিগণ উপনিষদ পাঠ করিতেছিলেন।
স্বামীজী তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আজ ঠাকুরের একজন মহাভক্ত এসেছেন।
নাগ-মহাশয়ের শুভাগমনে আজ তোদের পাঠ বন্ধ থাকলো।
’ সকলেই বই বন্ধ করিয়া নাগ-মহাশয়ের চারিদিকে ঘিরিয়া বসিল।
স্বামীজীও নাগ- মহাশয়ের সম্মুখে বসিলেন।
স্বামীজী। (সকলকে লক্ষ্য করিয়া) দেখছিস! নাগ-মহাশয়কে দেখ;
ইনি গেরস্ত, কিন্তু জগৎ আছে কি নেই, এঁর সে জ্ঞান নেই;
সর্বদা তন্ময় হয়ে আছেন! (নাগ-মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া) এই সব ব্রহ্মচারীদের ও আমাদের ঠাকুরের কিছু কথা শোনান।
নাগ-মহাশয়। ও কি বলেন! ও কি বলেন! আমি কি বলব?
আমি আপনাকে দেখতে এসেছি;
ঠাকুরের লীলার সহায় মহাবীরকে দর্শন করতে এসেছি;
ঠাকুরে কথা এখন লোকে বুঝবে।
জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী। আপনিই যথার্থ রামকৃষ্ণদেবকে চিনেছেন।
আমরা ঘুরে ঘুরেই মরলুম।
নাগ-মহাশয়। ছিঃ! ও-কথা কি বলছেন!
আপনি ঠাকুরের ছায়া-এপিঠ আর ওপিঠ;
যার চোখ আছে, সে দেখুক।
স্বামীজী। এ-সব যে মঠ-ফঠ হচ্ছে, এ কি ঠিক হচ্ছে?
নাগ-মহাশয়। আমি ক্ষুদ্র, আমি কি বুঝি?
আপনি যা করেন, নিশ্চয় জানি তাতে জগতের মঙ্গল হবে-মঙ্গল হবে।
অনেকে নাগ-মহাশয়ের পদধূলি লইতে ব্যস্ত হওয়ার নাগ-মহাশয় উন্মাদের মতো হইলেন।
স্বামীজী সকলকে বলিলেন,
'যাতে এঁর কষ্ট হয়, তা ক’রো না। '
শুনিয়া সকলে নিরস্ত হইলেন।
স্বামীজী। আপনি এসে মঠে থাকুন না কেন?
আপনাকে দেখে মঠের ছেলেরা সব শিখবে।
নাগ-মহাশয়। ঠাকুরকে ঐ কথা একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
তিনি বললেন, 'গৃহেই থেকো।
' তাই গৃহেই আছি; মধ্যে মধ্যে আপনাদের দেখে ধন্য হয়ে যাই।
স্বামীজী। আমি একবার আপনার দেশে যাব।
নাগ-মহাশয়। (আনন্দে উন্মত্ত হইয়া), এমন দিন কি হবে?
দেশ কাশী হয়ে যাবে, কাশী হয়ে যাবে।
সে অদৃষ্ট আমার হবে কি?
স্বামীজী। আমার তো ইচ্ছা আছে।
এখন মা নিয়ে গেলে হয়।
নাগ-মহাশয়। আপনাকে কে বুঝবে-কে বুঝবে?
দিব্য দৃষ্টি না খুললে চিনবার জো নেই।
একমাত্র ঠাকুরই চিনেছিলেন; আর সকলে তাঁর কথায় বিশ্বাস করে মাত্র, কেউ বুঝতে পারেনি।
স্বামীজী। আমার এখন মাত্র ইচ্ছা,
দেশটাকে জাগিয়ে তুলে-মহাবীর যেন নিজের শক্তিমত্তায় অনাস্থাপর হয়ে ঘুমুচ্ছে—সাড়া নেই, শব্দ নেই।
সনাতন ধর্মভাবে একে কোনরূপ জাগাতে পারলে বুঝব,
ঠাকুরের ও আমাদের আসা সার্থক হল।
কেবল ঐ ইচ্ছাটা আছে—মুক্তি-ফুক্তি তুচ্ছ বোধ হয়েছে।
আপনি আশীর্বাদ করুন যেন কৃতকার্য হওয়া যায়।
নাগ-মহাশয়। ঠাকুরে আশীর্বাদ।
আপনার ইচ্ছার গতি ফেরায় এমন কাকেও দেখি না;
যা ইচ্ছ করবেন, তাই হবে।
স্বামীজী। কই কিছুই হয় না-তাঁর ইচ্ছা ভিন্ন কিছুই হয় না।
নাগ-মহাশয়। তাঁর ইচ্ছা আর আপনার ইচ্ছা এক হয়ে গেছে;
আপনার যা ইচ্ছা, তা ঠাকুরে ইচ্ছা।
জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী। কাজ করতে মজবুত শরীর চাই;
এই দেখুন, এদেশে এসে অবধি শরীর ভাল নেই; ওদেশে বেশ ছিলুম।
নাগ-মহাশয়। শরীর ধারণ করলেই-ঠাকুর বলতেন-'ঘরের টেক্স দিতে হয়।
' রোগশোক সেই টেক্স।
আপনি যে মোহরের বাক্স; ঐ বাক্সের খুব যত্ন চাই।
কে করবে? কে বুঝবে?
ঠাকুরই একমাত্র বুঝেছিলেন।
জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী। মঠের এরা আমার যত্নে রাখে।
নাগ-মহাশয়। যাঁরা করছেন তাঁদেরই কল্যাণ, বুঝুক আর নাই বুঝুক।
সেবার কমতি হ’লে দেহ রাখা ভার হবে।
স্বামীজী। নাগ-মহাশয়! কি যে করছি, কি না করছি-কিছু বুঝতে পাচ্ছিনে।
·
এক এক সময়ে এক এক দিকে মহা ঝোঁক আসে,
·
সেই মতো কাজ করে যাচ্ছি,
·
এতে ভাল হচ্ছে কি মন্দ হচ্ছে,
·
কিছু বুঝতে পারছি না।
নাগ-মহাশয়। ঠাকুর যে বলেছিলেন—'চাবি দেওয়া রইল।'
তাই এখন বুঝতে দিচ্ছেন না।
বুঝামাত্রই লীলা ফুরিয়ে যাবে।
স্বামীজী। একদৃষ্টে কি ভাবিতেছিলেন।
এমন সময়ে স্বামী প্রেমানন্দ(বাবুরাম মহারাজ) ঠাকুরের প্রসাদ লইয়া আসিলেন এবং নাগ-মহাশয় ও অন্যান্য সকলকে দিলেন।
নাগ-মহাশয় দুই হাতে করিয়া প্রসাদ মাথায় তুলিয়া 'জয় রামকৃষ্ণ' বলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন।
সকলে দেখিয়া অবাক।
প্রসাদ পাইয়া সকলে বাগানে পায়চারি করিতে লাগিলেন।
ইতোমধ্যে স্বামীজী একখানি কোদাল লইয়া আস্তে আস্তে মঠের পুকুরের পূর্বপারে মাটি কাটিতেছিলেন-নাগ-মহাশয় দর্শনমাত্র তাঁহার হস্ত ধরিয়া বলিলেন, ‘আমরা থাকতে আপনি ও কি করেন?’
স্বামীজী কোদাল ছাড়িয়া মাঠে বেড়াইতে বেড়াইতে গল্প বলিতে লাগিলেনঃ
ঠাকুরের দেহ যাবার পর একদিন শুনলুম,
নাগ-মহাশয় চার-পাঁচ দিন উপোস করে তাঁর কলকাতার খোলার ঘরে পড়ে আছেন;
আমি, হরি ভাই(স্বামী তুরিয়ানন্দ) ও আর একজন মিলে তো নাগ-মহাশয়ের কুটীরে গিয়ে হাজির;
দেখেই লেপমুড়ি ছেড়ে উঠলেন।
আমি বললুম—আপনার এখানে আজ ভিক্ষা পেতে এসেছি।
অমনি নাগ-মহাশয় বাজার থেকে চাল, হাঁড়ি, কাঠ প্রভৃতি এনে রাঁধতে শুরু করলেন।
আমরা মনে করেছিলুম—আমরাও খাব, নাগ-মহাশয়কেও খাওয়াব।
রান্নাবান্না ক’রে তো আমাদের দেওয়া হল;
আমরা নাগ-মহাশয়ের জন্য সব রেখে দিয়ে আহারে বসলুম।
আহারের পর, ওঁকে খেতে যাই অনুরোধ করা আর তখনি ভাতের হাঁড়ি ভেঙে ফেলে কপালে আঘাত করে বলতে লাগলেন—
'যে দেহে ভগবান-লাভ হল না,
সে দেহকে আবার আহার দিব?'
আমরা তো দেখেই অবাক!
অনেক করে পরে কিছু খাইয়ে তবে আমরা ফিরে এলুম।
স্বামীজী। নাগ-মহাশয় আজ মঠে থাকবেন কি?
শিষ্য। না। ওঁর কি কাজ আছে, আজই যেতে হবে।
স্বামীজী। তবে নৌকা দে। সন্ধ্যা হয়ে এল।
নৌকা আসিলে শিষ্য ও নাগ-মহাশয় স্বামীজীকে প্রণাম করিয়া কলিকাতা অভিমুখে রওনা হইলেন।
-------------------------------------------------------------------------------------
বিবেকানন্দ কে প্রথম দেখি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে
সাধু নাগ মহাশয় [দুর্গাচরণ নাগ]/ সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ জন্ম - (১৮৪৬ এর ২১ আগস্ট -১৮৯৯) -- শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ গৃহী ভক্ত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবসায়ে খ্যাতি সম্পন্ন।
ঢাকার অদুরে নারায়ণগঞ্জেরে দেওভোগ গ্রামে জন্ম।
ভক্ত সুরেশচন্দ্র দত্তের সাথে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে যান। (১৮৮২/৮৩ খ্রীষ্টাব্দে)।
কাশীপুরে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের রোগ নিজ দেহে আকর্ষণ করে নিতে চেষ্টা করিলে ঠাকুর তাঁকে নিরস্ত করেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে ‘জ্বলন্ত আগুন’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রীমাসারদা দেবীকে নাগমহাশয় সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞান করতেন।
এই জ্ঞানানুভূতির তীব্রতায় আত্মহারা হয়ে পড়তেন বলে মায়ের কাছে যেতে তাঁর অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হত।
তিনি বলতেন বাপের চেয়ে মা দয়াল।
শ্রীশ্রীমা
সারদা দেবী এবং স্বামীজীও তাঁর অসীম ভক্তি ও মহাপুরুষোচিত গুণাবলীর অশেষ প্রশংসা করতেন।
No comments