প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ওঙ্কারানন্দ (১৮৯৪-১৯৭৩)
প্রাচীন সাধুদের কথা _স্বামী ওঙ্কারানন্দ (১৮৯৪-১৯৭৩)
Sri
Ramakrishna
|
স্বামী ওঙ্কারানন্দ (১৮৯৪-১৯৭৩)
এ
জগতে ভগবান কাউকে দুর্বল শরীর
ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেন,
আবার
কাউকে সবল শরীর এবং অল্প ও
মলিন বুদ্ধি দেন। ভগবান কিন্তু
ওঙ্কারানন্দজীকে দিয়েছিলেন
সুস্থ ও সবল দেহ,
তীক্ষ
ও শাণিত বুদ্ধি,
সতেজ
প্রাণ ও পবিত্র মন,
হৃদয়ভর্তি
ভালবাসা। তাঁর তীব্র পুরুষকার,
অগাধ
শাস্ত্রজ্ঞান,
অপূর্ব
মেধা,
ঠাকুর-মা-স্বামীজীর
প্রতি উপচে-পড়া
ভক্তি ও তীক্ষ্ণ বাগ্মিতা
সাধু-ভক্তদের
মুগ্ধ করত,
অনুপ্রেরণা
জোগাত। ভেঙে পড়া মানুষকে
তিনি যে কীভাবে চাঙ্গা করে
দিতেন,
তা
যারা তাঁর সঙ্গ করেছে তারাই
স্বীকার করেছে। এটা বড়ই
দুঃখের যে,
রামকৃষ্ণ সংঘের এসব বিশিষ্ট সন্ন্যাসীর
সম্পূর্ণ জীবনকাহিনি লিপিবদ্ধ
হলাে না।
১৯৬০
সাল। আমি তখন সবে অদ্বৈত আশ্রমে
যােগদান করেছি,
আমাদের
যেদিন পাবলিকেশন অফিস বন্ধ
থাকত। সেদিন আমরা কখনাে বেলুড় মঠ
বা উদ্বোধনে বা কাঁকুড়গাছিতে
যেতাম। সারাদিন বৃদ্ধ ও প্রাচীন
সাধছেন করে সন্ধ্যায় আশ্রমে
ফিরে আসতাম। আমার পরিষ্কার
মনে আছে এতে রবিবার দিবাংশু
মহারাজ,
বিধান
মহারাজ,
রাম
মহারাজ ও আমি
ওঙ্কারানন্দজীর
কাছে যাই এবং কাঁকুড়গাছিতে
প্রসাদ পাই। তারপর বিকালে
মহারাজ আমাদের জন্য কফি করলেন
এবং বললেন,
“দেখ,
ঠেলাওয়ালা,
মুটে-মজুর,
রিক্সাওয়ালারা
সব চা খায়;
আর
কবি,
চিন্তাবিদ,
দার্শনিক,
বৈজ্ঞানিকরা
কফি খায়। তােরা কফি খা।” তিনি
চাইতেন আমরা যেন বড় হই।।
Sri
Ramakrishna
|
তারপর
চলল সঙ্গ ও প্রসঙ্গ। আমাদের
উদ্দেশ করে বললেন,
“দেখ,
তোদের
একটা
কথা বলি। আমি কলকাতার ছেলে।
এই কলকাতায় যদি বাঁচতে চাস,
তবে
রােজ শরীর থেকে দরদর করে ঘাম
ফেলবি (অর্থাৎ
exercise
করবি)।”
তারপর বললেন,
“আজকালকার
ছেলেগুলাে ঠাকুরস্বামীজীর
কথা দু-পাতা
পড়ে মঠে join
করে
নিজেদের সর্বজ্ঞ মনে করে।
খবরদার,
ওরকম
সর্বজ্ঞ হােসনি। ঠাকুর-স্বামীজীর
বই খুঁটিয়ে পড়। তন্ন তন্ন
করে পড়। ভেতরে ঢােক। তাঁদের
ভাব নিয়ে ডুবে যা। পল্লবগ্রাহী
হােসনিভাসা ভাসা জ্ঞান ভাল
না,
শাস্ত্র
পড়।”
আমি
বললাম,
“মহারাজ,
আপনি
মা ও ঠাকুরের সন্তানদের সঙ্গে
কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন এবং
তাঁদের কত স্নেহ ও কৃপা পেয়েছেন।
আপনি সেসব লিখুন যাতে আমরা
জানতে পারি।” তিনি
সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় বললেন,
“কে
তাঁদের কথা শুনতে চায়?”
উদ্বোধন
পত্রিকায় ১৩৭১ সালের জ্যৈষ্ঠ
ও আষাঢ় সংখ্যায় তিনি 'আনন্দ'
এই
ছদ্মনামে শ্রীরামকৃষ্ণের
উক্তির আলােকে ‘ব্ৰহ্ম ও শক্তি
অভেদ’ এবং নিত্য ও লীলা’ এই
প্রবন্ধ দুটি লেখেন। নিজে
প্রচারবিমুখ সন্ন্যাসী হলেও
তিনি শাস্ত্রের পঠন ও পাঠন
ছাড়েননি। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ
পণ্ডিত। তিনি নিয়মিত যােগােদ্যান,
ইনস্টিটিউট
অফ কালচার এবং হাওড়া রামকৃষ্ণ
বিবেকানন্দ আশ্রমে শাস্ত্রের
ক্লাস নিতেন। একদিন হাওড়া
আশ্রমে আমি মহারাজের সঙ্গে
ছিলাম। বাদলবাবু এক প্লেট
সন্দেশ মহারাজকে খেতে দেন।
তিনি সব খেয়ে ফেললেন। তিনি
খেতেও পারতেন আবার খাওয়াতেও
পারতেন। তারপর
শঙ্করীপ্রসাদ
বসুকে বললেন,
“দেখ
শঙ্করী,
আমার
ক্লাসের সময় এই বুড়ােবুড়ির
দলকে সামনে বসাবি না। ওদের
দেখলে উপনিষদের বাণী আমার
মুখ দিয়ে বেরােতে চায় না।”
শুনেছি কালচারে বক্তৃতাকালে
বলেছিলেন,
“উপনিষদ্
প্রদীপের আলােতে ঘড়ি ছাড়া
শিখতে হয়। অর্থাৎ,
এই
বিরাট হলে luxurious
seat-এ
আরামে বসে বারবার ঘড়ি দেখতে
থাকলে উপনিষদের মর্ম ভিতরে
ঢুকবে না। উপনিষদ্ শিখতে গেলে
স্থান,
কাল
ভুলতে হবে। মহারাজ ছিলেন উচিত
বক্তা। তাঁর কথা ছিল চাঁচাছােলা—মিথ্যা
মিষ্টি কথার ধার ধারতেন না।
Sri
Ramakrishna
|
আমাদের
অদ্বৈত আশ্রমের librarian
সত্যবাবু
ওঙ্কারানন্দজীর খুব ভক্ত
ছিলেন। আমি একদিন তাঁকে ঠাট্টা
করে বলি,
“আমরা
মিষ্টি কথা বলি আর আপনি আমাদের
ছেড়ে কাঁকুড়গাছিতে মহারাজের
বকুনি খেতে যান।” সত্যবাবু
উত্তরে বলেন,
“দেখুন,
অনঙ্গ
মহারাজের বকুনি আশীর্বাদ।
উনি বকুনি দিয়ে মানুষের
কুকর্ম নষ্ট করে দেন।”
বর্ষাকালে
কাঁকুড়গাছি আশ্রম প্রায়ই
জলে ডুবে যেত এবং মন্দিরের
ভিতরে জল ঢুকত। একবার ঠাকুরের
অস্থির কলসের মধ্যে জল ঢুকে
যায়। মহারাজ
ঐ কলস বের করে ঠাকুরের অস্থি
ও ভস্ম রােদে শুকান। রোদে
ছাতা মাথায় দিয়ে বসে সব
শুকিয়ে নতুন কলসে ঢুকিয়ে
seal
করান,
তারপর
ঠাকুরের নতুন প্রস্তর মূর্তি
তৈরি করার plan
করেন।
১৯৬৪-৬৫
সালে আমি যখন বেলুড় মঠের
ট্রেনিং সেন্টারে তখন এক
ভােররাতে তিনি অদ্বৈত আশ্রমের
ক্যামেরাম্যান বিশ্বনাথ
সেনগুপ্তকে নিয়ে হাজির।
ঠাকুরকে কাপড় পরানাের আগে
ঠাকুরের মূর্তির বিভিন্ন
angle-এ
ফটো তােলা হলাে। তারপর ঐ সব
ফটো sculptor-কে
দিলেন যাতে ঠাকুরের মূর্তি
বেলুড় মঠের মতাে সর্বাঙ্গসুন্দর
হয়। ঠাকুরের কাজ perfect
করবার
জন্য এসব সাধুর অদম্য উৎসাহ,
নিষ্ঠা,
চেষ্টা,
ভালবাসা
সত্যই দেখবার বিষয় ছিল।
ট্রেনিং
সেন্টার শেষ হলে আমি একদিন
কাঁকুড়গাছিতে গিয়ে বললাম,
“মহারাজ,
ট্রেনিং
শেষ হয়েছে। আপনাকে প্রণাম
করতে এলাম।” তিনি বললেন,
“তােকে
কেউ জুতােপেটা করেছে?”
“না।”
“তবে তাের ট্রেনিং শেষ হয়নি।
তাের অহঙ্কার ভাঙেনি। দেখ,
আমাদের
ট্রেনিং সারা জীবন চলবে।
‘যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি।
ক্রমাগত শিখতে থাক। শিক্ষার
কি শেষ আছে
রে?”
মহারাজের
কথা আমার প্রাণে খুব স্পর্শ
করেছিল। এই ৪৭ বছর বিদেশে
ঠাকুরের কাজ করছি,
তবুও
এখনাে সেই ছাত্রই রয়ে গেলাম।
ট্যান্টিন বলতেন
,
“Swamiji was a great learner, so he was ever fresh."
Sri
Ramakrishna
|
যাহােক,
কাঁকুড়গাছিতে
ঠাকুরের মর্মরমূর্তির প্রতিষ্ঠা
হবে। মহারাজ কাশী থেকে বেদজ্ঞ
ব্রাহ্মণ আনালেন রুদ্রযাগ
করাবার জন্য। আমি তখন অদ্বৈত
আশ্রমের ব্রহ্মচারীদের বেদপাঠ
শেখাই। মহারাজ আমাকে বললেন,
“দেখ,
তুই
তাের দল নিয়ে আয়। ঠাকুরের
সামনে বেদপাঠ ও রুদ্রপাঠ করবি।
ঐ কাশীর পণ্ডিতদের হারিয়ে
দিতে হবে-বুঝলি।”
তিনি কথার দ্বারা আমাদের
ভিতরের শক্তি জাগিয়ে দিতেন।
আমরা যখন উৎসবের সময় বেদপাঠ
করি কাশীর পণ্ডিতরা আমাদের
দিকে তাকাতে লাগলেন।
তারপর
তাে ভাণ্ডারা। নানারকম খাবার
ও মিষ্টি। মহারাজ তখন Vice
President. নিজেই
রসগােল্লার বালতি নিয়ে
সাধুদের পরিবেশন করলেন। আমার
পাশে স্বামী জীবানন্দজী
খাচ্ছিলেন। তাঁর ছিল diabetes.
মহারাজ
একথাবা রসগােল্লা তাঁর পাতে
দিয়ে বললেন,
“খা—ভালভাবে
খা।” “মহারাজ,
আমার
diabetes.”
“দেখ,
একদিন
না একদিন তুই মরবি। তবে খেয়েই
মর।”
আমার
ডায়েরিতে অনঙ্গ মহারাজের
বিভিন্ন ঘটনার কথা লেখা আছে,
যেগুলি
তিনি আমাদের বিভিন্ন সময়ে
বলেছিলেন।
No comments