শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদীক্ষা_শ্ৰীমতী কুন্তলিনী দাশগুপ্ত
শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদীক্ষা_শ্ৰীমতী কুন্তলিনী দাশগুপ্ত
|
শ্ৰীমতী কুন্তলিনী দাশগুপ্ত বৃহত্তর যশাের-এর নড়াইল জেলার কালিয়া গ্রামের অধিবাসী।
শ্রীমা সারদাদেবীর মন্ত্রশিষ্য শ্রীমানদাশঙ্কর দাশগুপ্তের সহধর্মিণী ।
১৯১৭ সনে দীক্ষার জন্য শ্রীশ্রীমাকে পত্র লেখেন।
পত্রের উত্তর পেয়েই কুন্তলিনী দাশগুপ্ত ১৯১৮ সনে কোলকাতায় উদ্বোধনে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে যান এবং প্রথম দর্শনেই শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদীক্ষা লাভ করে জীবন ধন্য করেন।
অশেষ সৌভাগ্যবশত আমি শ্রীশ্রীমার দর্শন ও তাঁর কৃপা লাভ করতে পেরেছিলাম।
আমি তখন ১৮ বছরের বালিকামাত্র।
বয়স্ক লােকদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা সমস্যা আমার ছিল না এবং মার কাছে আমি সেরূপ কিছুর সমাধানও চাইনি।
শিশুর মত সরল প্রাণে আমি চেয়েছিলাম তার কৃপা ও আশীর্বাদ।
আর তিনিও চিরকল্যাণময়ী জননীর মত স্নেহের সঙ্গে তা দান করে আমার প্রাণমন ভরে দিয়েছিলেন।
বেশ মনে আছে, তার প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি ব্যবহার বুকের ভেতর এক-একটি আনন্দের তরঙ্গ তুলেছিল।
আর আমাদের ন্যায় অধম সন্তানদেরও তিনি কত প্রশংসাই না করেছিলেন ! কেন করেছিলেন তা জানি না।
শুধু এটুকু জানি যে, আমরা এর যােগ্য ছিলাম না এবং এটা আমি তার সুগভীর স্নেহের নিদর্শন বলেই গ্রহণ করেছিলাম।
তাঁর নিকট হতে যখন ফিরে আসি তখন আমার হৃদয় পরিপূর্ণ, দেহ-মন এক অপূর্ব আশার আলােকে উদ্ভাসিত ! মার অপার্থিব স্নেহ-বিজড়িত সেই একটি দিনের স্মৃতিই এই বিবরণে লিখছি।
|
শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদীক্ষা_শ্ৰীমতী কুন্তলিনী দাশগুপ্ত
১৯১৭ সন।
আশ্বিন মাসে আমি দীক্ষার জন্য শ্রীশ্রীমার নিকট একখানি পত্র লিখেছিলাম ।
তার উত্তরে মা জয়রামবাটী হতে লিখেন যে,
তিনি ফাল্গুন মাসে কোলকাতায় আসবেন এবং তখন আমিও যেন আসি, আমার মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।
নানা কারণে ফাল্গুন মাসে আমার আর আসা হয়নি।
১৯১৮ সনে পূজার অল্প পূর্বে আমি কোলকাতায় পৌছি এবং তার পরদিন সকালবেলা উদ্বোধনে মায়ের বাটীতে যাই।
তখন বেলা প্রায় ৮টা ৩০ মিনিট হবে।
আমার সঙ্গে আমার স্বামী, তিন বছর বয়স্ক পুত্র ও আমার দাদা।
পুত্রটিকে গাড়িতে দাদার নিকট রেখে আমি স্বামীর সাথে মায়ের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।
স্বামী নিচে রইলেন, আমি উপরে গেলাম।
মা তখন ঠাকুর ঘরে পা ছড়িয়ে বসে তরকারী কুটছিলেন।
সেখানে আরও কয়েকটি ভদ্রমহিলা বসেছিলেন।
আমি তাদের নিকট মা কে জিজ্ঞেস করলে, তারা শ্রীশ্রীমাকে দেখিয়ে দিলেন।
আমি মায়ের পদতলে মাথা রেখে প্রণাম করলাম।
মা আমাকে হাত দিয়ে সামনের জায়গা দেখিয়ে বললেন, “বস।”
তখন যেক’জন ভদ্রমহিলা সেখানে ছিলেন তারা একে একে মাকে প্রণাম করে চলে গেলেন।
আমি মাকে বললাম,
মা, আমি দীক্ষা নিতে এসেছি।
মা সহজভাবে বললেন, “বুঝেছি” এবং সেসঙ্গে কুটনাে কাটা শেষ করে বঁটি তুলে উঠে পড়লেন।
|
উঠেই তিনি খাটের পার্শ্বে সামনা-সামনি দুখানি আসন পাতলেন এবং ছােট একটি গঙ্গাজলের কমণ্ডলু নিয়ে একখানি আসনে আমাকে বসতে বলে অপরখানিতে নিজে বসলেন।
আমি বসলে তিনি আমার হাতে গঙ্গাজল দিয়ে আচমন করালেন এবং ভগবানের নাম উচ্চারণ করতে বললেন।
এরপর তিনি আমাকে বিধিমত দীক্ষা দিয়ে জপ করা শিখিয়ে দিলেন।
জপ করার সময়ে আমি আঙ্গুল ফাঁক করে জপ করছিলাম দেখে মা আমাকে আঙ্গুলগুলি একত্র চেপে রেখে জপ করা দেখিয়ে দিলেন ।
কিন্তু আমি ঠিক পারছিলাম না, আঙ্গুলগুলি ফাঁক হয়ে যাচ্ছিল।
তখন মা বললেন,
“ওকি, জপের ফল বেরিয়ে যাবে যে।”
এর পর আমি ঠিকমত জপ করলাম।
দীক্ষান্তে এক অপূর্ব আনন্দে আমার প্রাণমন ভরে উঠল।
আমি মাকে প্রণাম করে বললাম,
“মা, আমার যেন জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য লাভ হয়।”
এ বলতে বলতে, কেন জানি না, কেঁদে ফেললাম।
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
“হবে বৈকি মা, হবে বৈকি”
বলেই পুনরায় বললেন,
“আহা মা তােমার কি ভক্তি !”
আমি তখন আরও কাঁদতে লাগলাম।
অনেক কষ্টে আত্মীয়-স্বজনের প্রবল বাধা অতিক্রম করে আমি মার কাছে আসতে পেরেছিলাম, তা মনে করে আমার আরও কান্না পেতে লাগল।
এরপর মা উঠে আমার হাতে একটি সন্দেশ দিয়ে বললেন, “খাও।”
আমি বললাম,
“মা, তােমার প্রসাদ খাব।”
মা তখন সন্দেশটি জিবে ঠেকিয়ে আমাকে দিলেন।
আমি তা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খেতে লাগলাম ।
মা এ সময় পাশের ঘরে মাকুকে মুড়ি দিচ্ছিলেন।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “মুড়ি খাবে মা
?"
এবং আমি কিছু বলার আগেই মেঝেতে মাকুর পাশে কিছু মুড়ি ঢেলে দিলেন !
তখন আমরা সেখানে বসে তেলেভাজা, নারকেলের ফালি ও মুড়ি খেলাম।
ঐ সময় মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কার সঙ্গে এসেছ মা?”
আমি উত্তর দিলাম-“স্বামীর সঙ্গে।”
মা ও “স্বামী কি করেন ?
কোথায় থাকেন ?”
আমি ঃ “তুমি তাকে চেন মা।
গেল বছরের আগের বছর জয়রামবাটীতে তােমার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে এসেছেন।”
শুনে মা তখন কিছু বললেন না।
এর অল্প পরেই পুরুষ-ভক্তরা মাকে প্রণাম করতে এলেন।
আমরা তখন পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
পুরুষ-ভক্তরা চলে গেলে, আমি মার ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই অবাক হয়ে দেখলাম যে, ঐ দরজার সামনেই মা আমার ছেলেটিকে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন।
ছেলেটি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “মা, সাদা মা?”
আমি বললাম, “হ্যা, সাদা মা।”
তখন মাকু প্রভৃতিও সেখানে এলে মা তাদের লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, “আহা, বেশ ছেলেটি গাে, বেশ ছেলেটি !” তারপর তিনি ছেলেটিকে একটি সন্দেশ খেতে দিলেন।
আমি মাকে তা প্রসাদ করে দিতে বললে মা তা পূর্বের ন্যায় জিবে ঠেকিয়ে দিলেন।
(পরে স্বামীর কাছে শুনেছি যে, তিনি যখন মাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন, তখন মা নিজ হতেই ছেলেটিকে দেখতে চাওয়ায় তিনি তাকে মার কাছে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমরা কেউই ছেলের বিষয় পূর্বে মাকে বলিনি)।
কিছুক্ষণ পরে আমরা পাশের ঘরে এলাম।
তখন মা আমার দেওয়া কাপড়খানি হাতে করে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই কাপড় তুমি এনেছ মা? বেশ কাপড় হয়েছে।”
তারপর মা আমার দিকে ও মাকু প্রভৃতির দিকে তাকিয়ে আমার স্বামীর সম্বন্ধে বললেন, ওকে আমি চিনতে পেরেছি।
ও যে দু’বছর আগে জয়রামবাটী গেছিল।
সেসঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা মা, ও ওকালতি ছেড়ে দিলে কেন?”
আমি তখন ছেলেমানুষ, কথা গুছিয়ে বলতে শিখিনি।
তাই থতমত খেয়ে সরল ছেলেমানুষের মত বলে ফেললাম, “তা না হলে মা তােমাকে যে ডাকা হয় না ।
” মা শুনে একটু মৃদু হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তা ঠিক মা, ও যারা পারে, তারাই পারে।
এরা কি পারে কখন ?”
এখানে এও উল্লেখযােগ্য যে, আমার স্বামীর ওকালতি ত্যাগের বিষয় আমরা কেউ পূর্বে মাকে কিছু বলি নি।
এর পর মা পুনরায় ঠাকুরঘরে গেলেন।
একটু পরে আমিও সেখানে গেলাম।
গিয়ে দেখি শ্রীশ্রীঠাকুরের পূজা হয়ে গিয়েছে এবং মা ঘরের মাঝখানে বসে দুখানি ছােট পাতায় করে জলখাবার খাচ্ছেন।
আমার পূর্বহতেই ইচ্ছা ছিল যে, মা খেতে খেতে আমাকে তার পাতের প্রসাদ দেন।
কিন্তু লজ্জায় কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
তাই একটু ঘুরিয়ে বললাম, “মা, আমি একটু ঠাকুরের প্রসাদ খাব ।”
মা প্রথম পাতা হতে কিছু তুলে দিতে গেলেন।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বললেন-“না, এতাে ঠাকুরের প্রসাদ নয়।”
বলেই পাশের অপর পাতাখানি হতে একটু তুলে দিলেন।
এর পর মা খেতে লাগলেন, আমি তার সামনে বসে রইলাম।
মা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তােমার ছেলে কি বলে আমাকে ?”
আমি বললাম, “সাদা মা বলে।”
মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন ?”
আমি হেসে বললাম, “বােধ হয় তােমার ছবিখানা সাদা দেখে।”
Sri Ramakrishna |
- “এই প্রেমানন্দ, এই।
- ব্রহ্মানন্দ, এ
- এই শশীরামকৃষ্ণানন্দ,
- এই শরৎ-সারদানন্দ,
এভাবে প্রত্যেকের নাম ধরে ছবি দেখানাে শেষ হলে, মা খাটের উপর বসলেন।
আমি তার সামনে নীচে বসলাম।
তখন মাকু প্রভৃতি এসে আমার হাতের চুড়ি, বালা প্রভৃতি দেখতে লাগল।
এসময়ে মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তােমার নামটি কি মা ?”
আমি নাম বললে মা মাকু প্রভৃতিকে বললেন,
“তােরা নামটি মনে রাখিস, যদি কখনও চিঠিটিঠি লেখে।”
এর পর সেখানে আর যে সকল কথা হতে লাগল তা সবই মেয়েলী কথা, লিখার মত কিছু নয়।
তবে এর মধ্যেও মার সুগভীর স্নেহ অনুভব করেছিলাম। তাই দু'একটি দৃষ্টান্ত দিলাম ঃ
(১) আমার হাতের সােনা বাঁধানাে লােহাটা ভেঙ্গে যাওয়ায় তা গড়াতে দিয়েছিলাম।
এটা আমার নিকট হতে জানার পরেও উপস্থিত কেউ কেউ আমার হাতে শাখার সঙ্গে লােহা না থাকায় ত্রুটি ধরে মন্তব্য করতে লাগলেন।
তখন মা তাঁদের দিকে চেয়ে বললেন,
“নোয়াটা ফেটে গিয়েছে, তাই ”
তখন তাঁরা চুপ করেন।
(২) অপর একজন মহিলা মার সামনে আমার বাঁকা সিঁথির বিষয় উল্লেখ করে।
মার কাছে আসার সময়ে আমি ব্যস্ততায় ; তাড়াতাড়ির মধ্যে আর চুল আঁচড়িয়ে আসতে পারিনি।
তাই আমার মাথায় পূর্বদিনের বাঁকা সিঁথিটাই রয়ে গিয়েছিল।
এখন মার সামনে ঐ বাঁকা সিঁথির কথা উঠায় আমি প্রথমে লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলাম ।
মা কি মনে করছেন ভেবে ভয়ে ভয়ে তার মুখের দিকে তাকাতেই তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন,
"তা এখন হয়েছে এই সৰ।”
তখন আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ।
মার এ গভীর স্নেহাশ্রয়ে নানা কথাবার্তায় আর কিছু সময় কাটলে আমার যাবার জন্য ডাক এলো।
মা জিজ্ঞেস করলেন,
“তােমার গাড়ি এসেছে ?”
আমি “হ্যা বলে তাকে প্রণাম করে উঠে পড়লাম ।
কিন্তু সিঁড়ির নিকট আসতেই মনে হলো যাবার সময় আমি মাকে একবার ভাল করে দেখলাম না।
তাই ফিরে গেলাম গিয়ে দেখি, ঠাকুরঘরে কেউ নেই।
আমি তখন বাইরের দিকের দরজা দিয়ে মুখ বাড়াতেই দেখি, মা বারান্দায় রেলিং ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছেন।
আমি উকি দিতেই মা আমার দিকে মুখ ফেরালেন ।
কিন্তু তার চোখে চোখ পড়তেই আমি লজ্জায় ছুটে চলে এলাম।
প্রাণের আকাক্ষা অপূর্ণই রয়ে গেল ।
কারণ, মাকে আমার এই প্রথম ও শেষ দর্শন।
তবে এটাই আমার জীবনের শ্রেঠতম সম্বল হয়ে আছে ।
Read More
No comments