শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভে ধন্য _সুরেশচন্দ্র চৌধুরী
শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভে ধন্য _সুরেশচন্দ্র চৌধুরী
(সুরেশচন্দ্র চৌধুরী বৃহত্তর ফরিদপুর-এর গােপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার ডহরপাড়া গ্রামে বসবাস করতেন।
১৯১৫ সনে মে মাসের কোন একসময়ে জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভে ধন্য হন।
আমরা পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) লােক।
ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল।
আমার বাবা গােপালগঞ্জে সরকারি উকিল ছিলেন।
সেজন্য আমার শৈশব ও কৈশাের গােপালগঞ্জেই কাটে।
স্কুলে পড়ার সময়েই আমি অনুশীলন সমিতির সদস্য হই এবং স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি।
কিছুদিন পর রাজদ্রোহের অপরাধে আমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং বছর দেড়েক কারাগারে কাটাই।
জেলে থাকার সময় সহবন্দী এক যুবক ডাক্তারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়।
তিনিও ছিলেন একজন স্বদেশী।
ডাক্তার বন্ধুটির কাছে সবসময় শ্রীরামকৃষ্ণ ও হটযোগ সিদ্ধ স্বামী বিবেকানন্দের কথা শুনতাম।
অনুশীলন সমিতির সভ্য হিসাবে এবং স্বদেশী করার সুবাদে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি আমি আগে থেকেই অনুরক্ত ছিলাম,
কিন্তু ডাক্তার বন্ধুটির সান্নিধ্যে তাদের প্রতি অনুরাগ আমার বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
তাঁর কাছেই আমি প্রথম জানতে পারি যে,
শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী তখনাে স্থূলদেহে বর্তমান আছেন এবং তিনি মাঝে মাঝে কোলকাতার বাগবাজারে তাঁর বাসভবনে থাকেন।
একথা শােনার পর থেকে আমার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয় কখন এবং কেমন করে আমি শ্রীশ্রীমায়ের দর্শন লাভ করব।
জেলে যে সামান্য মাসােহারা পেতাম তা আমি একটু একটু করে জমিয়ে রাখতাম মুক্তি পেলে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে যাবার পথ-খরচের জন্য।
১৯১৫ সনের মে মাসের এক সুন্দর সকালে খুলনা জেলার দৌলতপুর কারাগার থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হলাে।
মুক্তি পেয়েই একবস্ত্রে প্রাণের আবেগে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীশ্রীমাকে দর্শনের জন্য।
আমার তখন গন্তব্য বাগবাজারে উদ্বোধন কার্যালয় তথা শ্রীশ্রীমায়ের বাড়ি'।
অবশেষে সেখানে পৌছলাম কিন্তু মা তখন সেখানে ছিলেন না।
তিনি কোথায় রয়েছেন। সেকথা কাউকে জিজ্ঞেস না করেই আমি চলে গেলাম শ্যামবাজারে গৌরীমার শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী আশ্রমে।
READ MORE: দেবী হংসেশ্বরী ও মহাপুরুষ মহারাজ
বাংলাদেশে শ্রীমা সারদাদেবীর শিষ্যবৃন্দ ও তাদের স্মৃতিমালা শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভে ধন্য _সুরেশচন্দ্র চৌধুরী
আমি তখন ছেলেমানুষ, ভেবেছিলাম মায়ের নামে আশ্রম যখন তখন মাকে নিশ্চয় সেখানে দেখতে পাব।
বলা বাহুল্য, মা সেখানে ছিলেন না, তবে সেখানে গৌরী-মার দর্শন পেলাম ।
গৌরী-মা আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন।
আমার সব কথা শুনে গৌরী-মা আমাকে বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করতে উপদেশ দিলেন।
গৌরী-মাকে প্রণাম করে আমি আবার বেরিয়ে পড়লাম।
কিন্তু আমি যে মাকে দর্শন করতে এসেছি এবং মা কোথায় রয়েছেন তা সেখানে কাউকেই, এমনকি গৌরী-মাকেও জিজ্ঞেস করিনি।
ভেবে নিলাম, মা নিশ্চয়ই কামারপুকুরে আছেন।
সুতরাং এবার গন্তব্য কামারপুকুর ।
আমার সম্বল মাসােহারার মাত্র কয়েকটা টাকা।
তার কিছুটা ইতােমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে।
তখন কোলকাতা থেকে অনেক হাঙ্গামা করে কামারপুকুর যেতে হতাে।
কিছুটা ট্রেনে, অনেকটা পায়ে হেঁটে।
আমি সমস্ত পথ হেঁটেই চললাম।
জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রখর রৌদ্রে কোলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে চলেছি আমার আরাধ্যা দেবীপ্রতিমার দর্শনে।
খিদে পেলে খাই দু-পয়সার মুড়ি-বাতাসা। আর রাস্তার ধারে পুকুরের জল।
গ্রীষ্মের দাবদাহে দেহ জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল।
রাস্তার পাশের পুকুরে ডুব দিয়ে দেহ শীতল করি।
ভিজে জামাকাপড় গায়েই শুকিয়ে যায়।
তিনদিন পর দুপুরবেলা কামারপুকুর এসে পৌছলাম।
খুঁজে খুঁজে ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে শিবু-দাদার সঙ্গে দেখা হলাে।
শিবু-দাদা বললেন ঃ
“মা তাে এখানে নেই। মা তাে জয়রামবাটীতে।”
হালদারপুকুরে স্নান সেরে শিবু-দাদার কাছে দুটি ডাল-ভাত খেয়ে জয়রামবাটী যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
যাবার সময় শিবু-দাদাকে প্রণাম করতে তিনি বললেন :
“ঠাকুরের নিজের হাতে লাগানাে গাছের এই আমগুলি মাকে দিও।”
আমের পুঁটলিটি নিয়ে জয়রামবাটীর পথে বেরিয়ে পড়লাম।
যখন জয়রামবাটী পৌছলাম তখন পড়ন্ত বিকেল।
মায়ের বাড়ির সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন আমার রুক্ষসূক্ষ চেহারা ও মলিন বেশভূষা দেখে কেউ কেউ কিঞ্চিৎ অবাক হলেন বলে মনে হলাে।
তারপরে যখন জানলেন, আমি সদ্যমুক্ত জেলফেরৎ আসামী তখন তাদের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা গেল।
বললেন ঃ
“এমনিতেই রােজ পুলিশ এখানে এসে খোজখবর নেয়।
নতুন কাউকে দেখলে নানারকম জেরা করে ।
তােমাকে দেখলে তাে আর কথাই নেই।
তােমাকে তাে বেঁধে নিয়ে যাবেই, সেসঙ্গে মাকেও উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে দেবে।
সুতরাং তুমি এখুনি এখান থেকে চলে যাও।” এরকম যখন বাক্যালাপ চলছে তখন একটি ছােট ছেলে এসে বলল ঃ “কোলকাতা থেকে যে-ছেলেটি এখুনি এসেছে, মা তাকে ভিতরে ডাকছেন।”
বাংলাদেশে শ্রীমা সারদাদেবীর শিষ্যবৃন্দ ও তাদের স্মৃতিমালা শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভে ধন্য _সুরেশচন্দ্র চৌধুরী
দু'ফোঁটা জলও চোখের কোণে জমল বােধহয় মায়ের উদ্দেশে পাদ্যঅর্ঘ্য হয়েই।
বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখি মা বারান্দায় বসে আছেন।
যেন কতদিনের চেনা, সেভাবে মধুর কণ্ঠে বললেন ঃ
“যাও বাবা, হাত-মুখ ধুয়ে নাও। তারপর মুখে কিছু দাও।”
শিবু-দাদার দেওয়া আমের পুঁটলিটি মায়ের পায়ের কাছে রাখতে রাখতে বললাম ঃ
“এই আমগুলাে শিবু-দাদা পাঠিয়েছেন আপনার জন্য।”
শিবু-দাদার বাড়িতে দুপুরে খেয়ে এসেছি বললে মা বললেন ঃ “তা হােক, একটু কিছু মুখে দাও।”
হাত-মুখ ধুয়ে আসতে মা তার পাশে পাতা আসনে আমাকে বসতে বললেন এবং আমাকে কিছু খাবার দিতে বললেন, খাবার দেখতে সামান্যই একবাটি মুড়ি, আরেকটা ছােট বাটিতে গােটা চারেক নারকেল নাড়।
মা বললেন ঃ
“শিবুর ওখানে ভাত খেয়েছ।
এখন এই খাও বাবা, রাত্রে ভাল করে খাওয়াব।”
আহার্য সাধারণ, কিন্তু অসাধারণ তার আস্বাদ।
খাওয়া হলে মা বললেন ও “রাত্তিরটা কাছেই কষ্ট করে কাটাও।
কাল সকালেই স্নান করে তৈরি হয়ে থেক।
আমি ডেকে নেব। এখন তুমি বিশ্রাম কর গিয়ে।
বরদা তােমাকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দেবে।”
মায়ের নির্দেশে একটি ছেলে কাছেই একটি অর্ধনির্মিত বাড়িতে রাত্রে বিশ্রাম করার জন্য আমাকে নিয়ে গেল।
ছেলেটির নাম বরদা – পরবর্তী কালে স্বামী ঈশানানন্দ।
পরদিন সকালে স্নানাদি সেরে তৈরি হয়ে রয়েছি।
সকাল নটা নাগাদ বরদা এসে আমায় ডাকল।
বলল ঃ “মা ডাকছেন।” মায়ের (পুরনাে) বাড়িতে গিয়ে দেখি মা ঠাকুরঘরে পূজারতা।
আমি যেতে আমাকে ইঙ্গিতে ওখানে আগে থেকে পাতা একটি আসনে বসতে বললেন।
বসলাম সিংহাসনে শ্রীরামকৃষ্ণের পট ছিল।
মা বললেন ঃ
“বাবা, ঠাকুরকে প্রণাম কর।”
“ঠাকুর’ বলতে যে শ্রীরামকৃষ্ণকে মা বােঝাচ্ছেন তা আমি বুঝতে পারিনি।
ফলে আমি ঠিক করতে পারছিলাম না কাকে প্রণাম করব।
তখন আমি মাকেই প্রণাম করলাম এ ভেবে যে, তিনিই আমার ঠাকুর।
আমি মুখে কিছু না বললেও মার মুখে দেখলাম মধুর হাসি।
তারপর মা আমাকে কৃপা করে মহামন্ত্র দান করলেন।
কেমন করে করজপ করতে হবে তা দেখিয়ে তার সামনে আমাকে জপ করতে বললেন।
তারপর বললেন ঃ
“এখন বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ জপ কর।”
আধঘণ্টা পরে বললেন ঃ
“তােমার খাবার তৈরি আছে। তুমি বাবা, খেয়েই এখনি এখান থেকে রওনা হয়ে
বাংলাদেশে শ্রীমা সারদাদেবীর শিষ্যবৃন্দ ও তাঁদের স্মৃতিমালা
এখানে পুলিশের খুব উৎপাত ওরা প্রায় রােজ এসে খোজখবর নিয়ে যায়।
নতুন কোন ছেলে এলে তাকে জেরা করে, কখনাে কখনাে থানাতেও নিয়ে যায়।
তােমাকে দেখলে ওরা তােমাকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে পারে।"
মাকে প্রণাম করে পূজার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম বারান্দায় আমার জন্য আসন পাতা।
আসনে বসলাম, একজন মহিলা আমাকে খাবার দিলেন।
খাওয়া শুরু করার আগে মা এলেন।
এসে এক-টুকরাে মিছরি জিভে ঠেকিয়ে প্রসাদ করে আমার হাতে দিলেন।
খাওয়ার সময় মা পাশে বসে রইলেন।
খাওয়া শেষ হলে মাকে পুনরায় প্রণাম করে রওনা হলাম ।
মা আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, চিবুকে হাত দিয়ে চুমাে খেলেন।
রাস্তায় যখন আসছি, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
চোখে জল। যতক্ষণ আমাকে দেখা গেল ততক্ষণ আমাকে দেখছেন দেখলাম।
আনন্দে ভরপুর হয়ে আমি পথ চলছি।
কোথায় যাব কিছু ঠিক নেই।
রাস্তাতেই স্থির করলাম, সােজা বেলুড় মঠ যাব।
বেলুড় মঠে এসে উপস্থিত হলাম।
মঠে তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজ ছিলেন না।
সাধুরা আমাকে মহাপুরুষ মহারাজের কাছে নিয়ে গেলেন।
মহাপুরুষ মহারাজকে আমার সবকথা বললাম।
মায়ের কৃপা পেয়েছি শুনে এবং মঠে ব্রহ্মচারিরূপে থাকতে চাই জেনে তিনি আমাকে মঠে থাকার অনুমতি দিলেন।
- কিছুদিন মঠে ছিলামও ব্রহ্মচারী হিসাবে।
- কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি।
- মঠে তখন চিকিৎসার সুবিধা ছিল না।
মহাপুরুষ মহারাজ আমাকে বললেন ?
“তুমি এখন বাড়িতে গিয়ে ভাল করে খাওয়া-দাওয়া কর এবং চিকিৎসা করাও।
এখানে তাে খাওয়াও নেই, চিকিৎসারও সুবিধা নেই।”
বাড়ি ফিরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু বাড়ির চাপে, বিশেষ করে বৃদ্ধ বাবার চাপে আর বেরিয়ে আসতে পারলাম না।
মহাপুরুষ মহারাজকে পরিস্থিতি জানিয়ে চিঠি লিখলাম এবং এমতাবস্থায় তাঁর কি নির্দেশ তা জানতে চাইলাম।
উত্তরে মহাপুরুষ মহারাজ আমাকে লিখলেন :
“এটাই মায়ের ইচ্ছা জানবে। তুমি এখন বাড়িতেই থাক। বাবা-মায়ের সেবা কর। সৎ গৃহস্থ হও। সৎ গৃহীরও দরকার আছে, নাহলে ঠাকুরের পরিবার থাকবে কি করে ?”
মায়ের সঙ্গে পরবর্তী কালে আমার আর দেখা হয়নি, কিন্তু এ সামান্য দর্শনের স্মৃতিই আমার জীবনের প্রধান সম্বল।
লক্ষ্মীছাড়া হতে নেই রে-বলছেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ
No comments